কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে রাখাইন ভাষা

জেলা প্রতিনিধি, পটুয়াখালী: জেলারে  সরকারি কলেজে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স পড়ছে রাখাইন তরুণী খেমে চান চেলসি । বাংলা ভাষায়ও ভালো দখল আছে তার। কিন্তু নিজের রাখাইন ভাষাটা সে লিখতেও পারে না, পড়তেই পারে না। কারণ নিজের মাতৃভাষা হলেও রাখাইন ভাষাটা শেখার কোন সুযোগ পায়নি সে। বাবা-মায়ের সাথে পটুয়াখালী শহরের সবুজবাগ এলাকায় বৌদ্ধ বিহারে বাস করেন খেমে চান।

তার আক্ষেপ রাখাইন জাতি হয়েও সে রাখাইন ভাষা লিখতে পারে না বা পড়তে পারে না। সে ছোট বেলা থেকে বাবা-মায়ের মুখে শুনে শুনে ভাষাটা রপ্ত করেছে। তাই শুধু মুখে বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে খেমে চানের নিবেদন তারা যাতে রাখাইন ভাষা শিখতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করেন।

খেমে চানের বাবা ওই বৌদ্ধ বিহার সমিতির সাধারন সম্পাদক মংখান তালুকদার জানান, আমরা ছোটবেলা মন্দিরে পুরোহিতের কাছে গিয়ে রাখাইন ভাষা শিখেছি। তাই আমরা আমাদের মাতৃভাষা লিখতে, পড়তে ও বলতে পারি। কিন্তু আমাদের ছেলে-মেয়েরা মন্দিরে গিয়ে মাতৃভাষা শেখার সুযোগ পাচ্ছে না। তাই তারা মাতৃভাষা সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞ।

তিনি বলেন আমরা চাই সরকার এমন একটা ব্যবস্থা নিক যেন আমাদের শিশুরা ছোট বেলায়ই মাতৃভাষা শিখতে পারে। সেজন্য মন্দির ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরুকরা যেতে পারে বলেও মনে করেন এ রাখাইন নেতা। কলাপাড়া উপজেলার নতুনপাড়া
এলাকার বাসিন্দা চিং দামো ওরফে দামো রাখাইন বলেন, আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। তারা উভয়েই ডিগ্রীতে পড়াশুনা করছে। তারা এদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করলেও নিজের মাতৃভাষা শিখতে পারেনি।

কারণ বর্তমানে আমাদের ভাষা শেখানোর কোন ব্যবস্থা নেই। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা বড়দের মুখে শুনে শুনে শুধুমাত্র বলতে পারে কিন্তু লিখতে পারে না। আমাদের ভাষা শিক্ষার কোন সুযোগ সৃষ্টি করা না হলে আমাদের এ ভাষা একদিন হারিয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। নতুন পাড়া বৌদ্ধ মন্দিরের পুরোহিত উচন্দ্র বান্তে বলেন, এ পাড়ায় ৯ টি রাখাইন পরিবারে প্রায়
৪০ জন লোক রয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচ/ছয় জন শিশু রয়েছে। এসব শিশুরা স্থানীয় স্কুল- কলেজে পড়লেও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ও হিন্দু শিশুরা নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ পায় কিন্তু রাখাইন শিশুদের কেউ রাখাইন ভাষা
শেখার সুযোগ পায়না। সরকারের উচিত অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষা পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৌদ্ধ ধর্ম শেখানোরও ব্যবস্থা করা। এভাবে সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগের অভাব, যথাযথ চর্চা, মাতৃভাষায় শিক্ষা সংকট এবং সংরক্ষণের অভাবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ- জনগোষ্ঠী রাখাইন সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষা বিলুপ্তির পথে।

স্থানীয়রা জানান, ভাগ্য বিতাড়িত হয়ে এক হাজার ৭৮২ সালে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ থেকে পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও বরগুনার তালতলীতে এসে বসতি স্থাপন করে রাখাইন সম্প্রদায়। পরে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বরগুনা জেলার তালতলী এবং
পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী ও কলাপাড়ার উপকূলীয় অঞ্চলে করে পরিপূর্ণ জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তোলে আবাদি জমি। ধীরে ধীরে এদের পাশেই গড়ে ওঠে বাঙালি বসতি। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারায়, ভাষাগত দূরত্বের কারণে দিন দিন পিছিয়ে পড়ে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা থেকে।

পটুয়াখালীতে এবারই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হবে

বর্তমানে কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ২৮টি পাড়ায় (গ্রামে) প্রায় ৩০৪ টি রাখাইন পরিবারে প্রায় দুই হাজার রাখাইন বসবাস করেন। তারমধ্যে মিশ্রিপাড়া, লক্ষীপাড়া, মম্বিপাড়া, আমখোলা পাড়া, গোড়াআমখোলা পাড়া, পাঞ্জুপাড়া,কালাচাঁনপাড়া,নয়াপাড়া,মংথেপাড়া,নাইউরীপাড়া,কেরানীপাড়া, বেতকাটাপাড়া,বৌলতলীপাড়া,নাচনাপাড়া উল্লেখযোগ্য।

মিয়ানমারের উপভাষা রাখাইন ভাষায় কথা বলতে অভ্যন্ত এ জাতিগোষ্ঠীর জন্য শুরু থেকেই মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বিকল্প হিসেবে বাংলা ভাষাতেই লেখাপড়া করতে হচ্ছে। ফলে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও তারা
নিজেদের ভাষা পড়তে এবং লিখতে পারছে না এ সম্প্রদায়ের শিশুরা।

কলাপাড়া শহরের রহমতপুর সরকারি বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র মংথেন রাখাইন বলল, আমার স্কুলে রাখাইন ভাষা শিখানো হয় না। তাই আমরা আমাদের মাতৃভাষা শিখতে পারিনা। কুয়াকাটার বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ইন্দ্র বংশি ভিক্ষু জানান, আমাদের রাখাইন
ভাষা শেখানোর সরকারি বা সেরকারি কোন উদ্যোগ নেই। তাই রাখাইন শিশুরা তাদের মাতৃভাষা শিখতে পারছে না। এসব শিশুরা সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। যখন এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে তখন এসব শিশুদের বিহারে এনে রাখাইন ভাষা শেখানোর চেষ্টা করি কিন্তু তাও সকলকে আনা যায় না।

পটুয়াখালী জহির-মেহেরুন নার্সিং কলেজে শিরা বরণ অনুষ্ঠিত

কুয়াকাটার মিশ্রীপাড়া সীমা বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ উত্তম ভিক্ষু জানান, ২০ জন রাখাইন শিশুদের নিয়ে তিনি ২০১৫ সালে বিহারের পাশে গোলপাতার ঘরে একটি ‘রাখাইন ভাষা শিক্ষা স্কুল ’ চালু করেছিলেন। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় করোনা কালে তা বন্ধ হয়ে যায়।

নতুন প্রজন্মে শিশুরা রাখাইন ভাষা মুখে বলতে পারলেও তাতে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। একসময় বৌদ্ধ বিহারগুলিতে ভিক্ষুরা রাখাইন শিশুদেরকে রাখাইন ভাষা শেখাতেন কিন্ত্র এখন বর্ণমালার বইয়ের অভাবে তাও হচ্ছে না। রাখাইন ভাষার বর্ণমালার বইগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম বা মিয়ানমার থেকে আনতে হয় যা এখন দুষ্প্রপ্য হয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে পটুয়াখালী জেলা শিক্ষা অফিসার মুহাঃ মজিবুর রহমান জানান, পৃথক কোন প্রতিষ্ঠান না থাকায় রাখাইন শিশুরা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা গ্রহন করছে।

স্বাআলো/এস

Share post:

সাবস্ক্রাইব

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

সর্বাধিক পঠিত

আপনার জন্য প্রস্তাবিত
Related

পটুয়াখালীতে কৃষি উদ্যোক্তাদের দিন ব্যাপী দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ

জেলা প্রতিনিধি, পটুয়াখালী: জেলার আটটি উপজেলার দুইশ কৃষি উদ্যোক্তাদের...

চেয়ারম্যান প্রার্থী মিজানের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা

জেলা প্রতিনিধি, পটুয়াখালী: জেলার দুমকি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান...

পটুয়াখালীতে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালিত

জেলা প্রতিনিধি, পটুয়াখালী: সাংবাদিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধে...

পটুয়াখালীতে মহান মে দিবস পালিত

জেলা প্রতিনিধি, পটুয়াখালী: শ্রমিক মালিক গড়বো দেশ,স্মার্ট হবে বাংলাদেশ...