তিস্তার জেগে ওঠা চর এখন বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: জেলার বুক চিরে বয়ে গেছে নদী তিস্তা। অত্যন্ত খরস্রোতা তিস্তা নদীর শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে প্রায় পানি শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। পানি শূন্য চরে এ বছর ব্যাপকহারে রবি ফসল চাষ করেছে চাষিরা।

একরের পর একর জমি জুড়ে আবাদ করা হয়েছে পেঁয়াজ, ভুট্টা, গম, বাদাম, আলু, মরিচ, মিষ্টি আলু, মিষ্টিকুমড়া, মরিচ, সরিষা, তামাক, গাঁজর, ধান ও ধনিয়াপাতাসহ নানা শাকসবজি। ফসলের এসব খেতে কাজ করছেন কৃষক-কৃষাণী ও কয়েকশো দিনমজুর কৃষি শ্রমিক।

কেউ সেচযন্ত্রে (শ্যালো মেশিন), কেউ বা সৌরচালিত আবার কেউ বা বৈদ্যুতিক পাম্প দিয়ে ক্ষেতে পানি দিচ্ছেন। কেউ নিড়ানি দিচ্ছেন। আবার কেউ আগাছা তুলছেন। কর্মব্যস্ত তিস্তা পাড়ের নদীকূলের কৃষি ও দিনমজুর পরিবারগুলো। সবার স্বপ্ন বাম্পার ফলন হবে। সেই স্বপ্নের প্রধান বাঁধাও আছে, তা হচ্ছে উজানি ঢলে হরকার (আকস্মিক) বন্যায় ফসলহানির আশঙ্কা।

লালমনিরহাটে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালো ২ জন

গত বর্ষা মৌসুমে বন্যার কারণে এবারে তিস্তার চরে বাম্পার ফলন হয়েছে, সেই বন্যার আশঙ্কায় ফসলহানিতে ভুগছে কৃষক পরিবারগুলো। কৃষক পরিবারগুলোর দাবি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যাতে আলোচনা করে রাখে তিস্তায় উজানের ঢল যেনো শুস্ক মৌসুমে হঠাৎ না ছাড়ে। যাতে কমপক্ষে উঠতি ফসল তোলার সময় দেয়। অনেকে শিক্ষিত বেকার ধার দেনা করে প্রজেক্ট আকারে আলু, গম, ভুট্টা, গাঁজর চাষ করেছে। এসব প্রজেক্টে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলা, আদিতমারী উপজেলা, কালীগঞ্জ উপজেলা, হাতীবান্ধা উপজেলা ও পাটগ্রাম উপজেলার উপর দিয়ে প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার তিস্তা নদী প্রবাহিত। কোথাও এর প্রস্থ আট হতে ১২ কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে বিশাল বিশাল চর জেগে উঠেছে।

বিস্তৃত চরে এখন আবাদ হচ্ছে রবি ফসল। অথচ কয়েক বছর আগেও অবস্থা এ রকম ছিলো না। মাঠের পর মাঠ পরে থাকত ধু-ধু বালুচর। তিস্তা বর্ষা ও শুষ্ক দুই মৌসুমে ছিলো মানুষের কাছে অভিশাপ । এখন দিন পাল্টে গেছে। তিস্তার চরের বালুর এসব জমিতে এখন নানা রকমের শাকসবজি ফলিয়ে আয় করছেন স্থানীয় কৃষকেরা।

লালমনিরহাট জেলা পরিষদের উপ-নির্বাচন ৯ মার্চ: চেয়ারম্যান পদে ৫ জনের মনোনয়নপত্র দাখিল

গত কয়েক বছরের চেয়ে এবার দুই উপজেলায় সর্বাধিক রবি শস্যের আবাদ হয়েছে। কারণ, গত বছরের বন্যার পর এবার চরে পলি পড়েছে বেশি। গত বর্ষা মৌসুমে ভারতের সিকিমে চারশো বছরের পুরনো একটি বাঁধ ভেঙে যায়। সেই বাঁধের পলিমাটি প্রবাহিত হয়ে আসে তিস্তা নদী দিয়ে। গোটা তিস্তায় বালুতে জমে যায় প্রায় চার ইঞ্চি পুরুত্বের পলি জমে যায়। সেই পলির কারনে ফসল হয়েছে সবুজের সমারোহ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রমতে, তিস্তা ও ধরলা নদী বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। এ নদী দুইটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা হয়ে প্রবাহিত। গতিপথ পরিবর্তন করে উপজেলা দহগ্রাম ইউনিয়নের বৃহত্তর অংশ জুড়ে বয়ে চলেছে তিস্তা। মূলত দহগ্রাম হতে আবার ভারত হয়ে চলে গেছে পরে আবার ভারত হয়ে পাশের হাতীবান্ধায় তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এভাবে কুড়িগ্রামে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশে গেছে।

অপরদিকে ভারতের চ্যাংড়াবান্দা হয়ে পাটগ্রামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ধরলা নদী। পাটগ্রাম উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবারো ভারতে ঢুকেছে। এভাবে আবারো লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নে ধরলা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদী দুইটির প্রবশে মুখে ভারত সরকার বাঁধ তৈরি করেছে। এতে করে ভারত এই নদী দুইটির পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তারা শুষ্ক মৌসুমে পুরো পানি প্রত্যাহার করে নেয় আবার বর্ষা অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়। এতে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়।

লালমনিরহাটে ১৯ জনের মনোনয়ন বৈধ, ৮ প্রার্থীর বাতিল

২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর ও ১৮ অক্টোবর উজান হতে আকস্মিক ঢল ছেড়ে দেয়া তিস্তা নদীর উপকূল দহগ্রামসহ তিস্তা পাড়ের কমপক্ষে ৫৫টি গ্রামে প্রবল বন্যা দেখা দেয়। বর্তমানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তিস্তা নদীল পানির তোড়ে প্রতি বছর দহগ্রাম ছিটমহলটির জমি ভেঙে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তিস্তা নদী গর্ভে। এমন চলতে থাকলে বাংলাদেশের মানচিত্র হতে একদিন হারিয়ে যাবে দহগ্রাম আঙ্গোরপোতা ছিটমহলটি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কার্যালয় সূত্র জানায়, হাতীবান্ধা উপজেলায় ২৩ হাজার ৫২৭ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি আছে। শুধু তিস্তার চরে ভুট্টার চাষ হয়েছে এক হাজার ৮৯৭ হেক্টর জমিতে। এ ছাড়া গম ১৫ হেক্টর, আলু ১৫ হেক্টর, মরিচ ১০ হেক্টর ও চিনাবাদাম ৭৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে। আর পাটগ্রাম উপজেলায় ২১ হাজার ২৬০ হেক্টর চাষযোগ্য আবাদি জমি রয়েছে। এবার উপজেলার দহগ্রাম তিস্তার চর ও জগতবেড় এবং জোংড়া ইউনিয়নের ধরলা নদীর চরাঞ্চলে ভুট্টা আবাদ হচ্ছে ৬৫ হেক্টর জমিতে। একই সঙ্গে গম ২৫ হেক্টর, আলু ১৫ হেক্টর ও মিষ্টিকুমড়া ৮ হেক্টর জমিতে চাষ করা হচ্ছে। জেলায় তিস্তার চরাঞ্চল নিয়ে কোনো পৃথক হিসেবে কৃষি বিভাগের কাছে নেই। তিস্তার চরাঞ্চলের কৃষি নিয়েও কোনো পৃথক পরিকল্পনা কৃষি বিভাগের নেই। তারা জেলার কৃষির মধ্যে চরের কৃষিকে অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে। চরের কৃষক ও কৃষি নিয়ে কৃষি বিভাগের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তিস্তা ও ধরলা চরের কৃষি যে পৃথক কৃষি পরিকল্পনায় হয়ে আসছে সেটার পুরো কৃতিত্ব চরের কৃষকের।

পাটগ্রামের কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবদুল গাফ্ফার ও হাতীবান্ধা কৃষি কর্মকর্তা সুমন মিয়া জানান, বর্ষার শেষ দিকে তিস্তা ও ধরলা নদীতে হরকা বন্যা হয়। এতে বর্ষা মৌসুমের বন্যার পানির সাথে ব্যাপক ঘোলা পানি আসে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি স্থির হলে সেই ঘোলা পানি চরগুলোতে কাদামাটির আস্তরণ ফেলে, সেইটি মূলত পলিমাটি। এতে স্থানীয় কৃষকেরা সবাই তিস্তার চরে চাষাবাদে ঝুঁকে পড়েছে। এবারে ফসল ফলেছে বাম্পার। কম খরচে ফসল বেশ ভালো হয়েছে। রবি ফসল আলু, বেগুন, কপি ও সবজিতে কৃষক দামও পেয়েছে। বাড়তি পেঁয়াজ, রসুন, কাউন, ধান, তামাক, গম, ভুট্টা ফসল চরে রয়েছে। কৃষকের ভয় আকস্মিক বন্যার। যদি আকস্মিক বন্যা না হয়, ফলন ভালো হবে। কৃষকদের চাহিদা মতো প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ জানান, তিস্তা চরের উজানি ঢলের খবর ভারত জানালে তাৎক্ষণিক পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানানো হয়। ভারত সরকার বন্যার খবর জানালে আমরা দ্রুত চরাঞ্চলের মানুষকে জানাবো। ফসল রক্ষায় হঠাৎ যাতে শুষ্ক মৌসুমে বন্যা না আসে বিষয়টি সরকারকে জাননো হবে। আপনারাও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ রাখবেন।

স্বাআলো/এসআর/এস

Share post:

সাবস্ক্রাইব

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

সর্বাধিক পঠিত

আপনার জন্য প্রস্তাবিত
Related

কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চাচা-ভাতিজার জমজমাট লড়াই

হাসানুজ্জামান হাসান,লালমনিরহাট: সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে এবং মন্ত্রীর...

কালীগঞ্জে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে কাজ বন্ধ, বিক্ষোভ

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: জেলার কালীগঞ্জে আকিজ বিড়ি কোম্পানি হাজরানিয়া...

আইটিএফ চ্যাম্পিয়নশিপে লালমনিরহাটের সান্ত্বনার স্বর্ণ পদক জয়

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: তায়কোয়ান্দো আইটিএফ চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় লালমনিরহাটের সান্ত্বনা...

কালীগঞ্জে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হলেন লুবনা

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ...