জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পে কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ

রংপুর ব্যুরো : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর আওতায় ‘জমি আছে-ঘর নেই’ প্রকল্পে কুড়িগ্রাম ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় তালিকায় নাম থাকলেও এক বছরেও ঘর জোটেনি অনেকের ভাগ্যে। এছাড়াও সরকারের দেয়া এসব ঘরে নিম্নমানের খুঁটিসহ ঘর ও লেট্রিনের কাজ অসমাপ্ত রাখার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও মেলেনি সুরহা। নিম্নমানের কাজ করে কোটি টাকারও বেশি অর্থ তসরুপ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনিয়ম-দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।

ভুরঙ্গামারী উপজেলার শিলখুড়ি ইউনিয়নের উত্তরছাট গোপালপুরের বাসিন্দা মৃত: ইব্রাহিমের স্ত্রী হালিমা বেওয়া (৪৫)। ঘরে ২টি কন্যা সন্তান রেখে অসুস্থ অবস্থায় স্বামী মারা যায় প্রায় ২০ বছর আগে। অভাব অনটনের সংসারে অন্যের সাহায্য আর বাবার বাড়ির সহযোগিতায় কোন রকমের দিন পার করছেন হালিমা বেওয়া। স্বামীর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৫শতক জমিতে কোন রকমেই দিন কাটছে তার। গত অর্থ বছরে বিনামূল্যে সরকারের দেয়া জমি আছে ঘর নাই প্রকল্পে তালিকায় নাম থাকলেও এখনও সেই ঘর মেলেনি।

একই ইউনিয়নের শালঝোড় গ্রামের মৃত: আজগর আলীর স্ত্রী হাউসি বেওয়া (৫০) এবং কেরামত আলী (৫০)’র নাম প্রকল্পে থাকলেও ঘর জোটেনি তাদের কপালেও। দারিদ্রপীড়িত জেলা কুড়িগ্রামে গৃহহীনদের মাথা গোঁজার ঠাই করে দেবার জন্য বছর কয়েক থেকে গৃহ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। অথচ মাঠ পর্যায়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানান অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কাজ শেষ না করেই কাজ সমাপ্ত দেখানো হয়েছে। অথচ ঘর এবং লেট্রিনের কাজ শেষ না করেই ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে সুবিধাভোগীদের নিকট। ঘর নির্মাণের খুঁটি এবং মেঝেতে নিম্নমানের সামগ্রি ব্যবহারের অভিযোগতো আছেই। কোথাও কোথাও বানানো খুঁটির বদলে কেনা খুঁটি দেয়া হয়েছে। প্রায় ১০ফিট উচ্চতা টিনসেড ঘরে দেয়া হয়েছে দুর্বল কাঠ এবং বাশ। ঘরের দরজাতে প্লেন্সিটের বদলে টিন দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ঘর নির্মাণে বেচে যাওয়া অর্থ দেয়া হয়নি সুবিধাভোগীদের। উল্টো সুবিধাভোগীরাই ধারদেনা করে ঘরের সরঞ্চামাদী বহন করেন। এক লক্ষ টাকা বরাদ্দের ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রি ব্যবহার করে গড়ে প্রতি ঘর ৫০ থেকে ৭০হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন সুবিধাভোগীরা।

হালিমা বেওয়া, হাউসি বেওয়া এবং কেরামত আলী বলেন, ‘সরকারের দেয়া ঘরের তালিকায় হামার নাম ছিল। অথচ এক বছর হয়া গেলই কোন ঘর পাই নাই। ঘরের জন্য চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও স্যারের কাছে গেছি কিন্তু কোন উপকার হয় নাই। ঘর পামো কিনা জানি না।’

এছাড়াও ঘর পাওয়া জহুরা খাতুন (৫০) ও শহিদুল ইসলাম (৪৮) বলেন, ‘সরকারের দেয়া বিনামূল্যে হামরা ঘর পাইছি। কিন্তু সেই ঘরের কাজ এলাও বাকি আছে। এলাও লেট্টিন বসায় নাই। রিং-স্লাব রেখে চলি গেছে। এলা কামলা নিয়া হামাকেই বসাইতে হবে এ গুলা। ঘরের মধ্যে বানানো খুঁটি না দিয়া কেনা খুঁটি দিয়ে ঘর বানাইছে। কাউকে কেনা খুঁটি আবার কাউকে বানানো খুঁটি দিয়ে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে। ঘরের মালামাল আনাসহ এক বস্তা সিমেন্ট, বালু, খোয়া, কাঠ-বাশ কিছু করে কিনে দেয়ায় প্রায় ৭/১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এসব টাকা তারা সম্পদ হানী এবং ঋণ করে ব্যয় করেছেন বলে জানান তারা।’

যার জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পে অনিয়ম আর দুর্নীতি দেখে প্রকল্প পরিচালক, দুদকসহ প্রশাসনের নিকট গত বছরের অক্টোবর মাসে লিখিত অভিযোগ করেন  আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুল হক।

তিনি বলেন, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা এবং উন্নয়নের বাধা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু এই অভিযোগ করার কারণে প্রশাসন এবং প্রভাবশালীদের তোপের মুখে পড়েছেন।  ফলে প্রায় সময় পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে।

আরো পড়ুন>> রংপুর সিটি মেয়র মোস্তফাকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ

শিলখুঁড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ইসমাঈল হোসেন ইউসুফ জানান, তিনি স্বীকার করেন তার ইউনিয়নে তালিকাভুক্ত নামধারীগণ ঘর পায়নি। এই প্রকল্পে ক্রয় কমিটিতে চেয়ারম্যানগণ শুধু মাত্র সদস্য। ঘরের মালামাল ক্রয় করাসহ নির্মাণ কাজ পুরোটাই করেন ইউএনও স্যার নিজেই। আমরা চেয়ারম্যানগণ শুধু তালিকা দিয়েছি। সংশোধন করা না করা ইউএনও স্যার নিজেই জানেন। ক্রয় কমিটির রেজুলেশনে ১০জন চেয়ারম্যানের মধ্যে ৬জন চেয়ারম্যানই  স্বাক্ষর করেনি বলে দাবি করেন।

ভূরুঙ্গামারীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস.এইচ.এম. মাগ্ফুরুল হাসান আব্বাসী দাবি করেন জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পে কোন অনিয়ম হয়নি। উপজেলায় ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ৪২৯টি ঘরের জন্য এক লাখ করে মোট ৪ কোটি ২৯লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সে কাজও সমাপ্ত করেছেন। এরমধ্যে ১০/১২টি ঘরের তালিকা সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানান।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে লিখিত কোন অভিযোগ তার জানা নেই। তবে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দেন তিনি।

স্বাআলো/এম

.

Author