কুড়িগ্রামে নৌকায় ৭ হাজার পরিবারের বসবাস

জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে বন্যার পানি ধীর গতিতে কমতে শুরু করায় দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসীদের। নিন্মাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ি-ঘর তলিয়ে থাকায় এবং পার্শ্ববর্তী কোন উঁচু জায়গা না থাকায় পানিবন্দি মানুষেরা পরিবার পরিজন নিয়ে ডিঙ্গি নৌকা ও কলা গাছের ভেলায় অবর্ণনীয় কষ্টে বসবাস করছেন। দুর্গম চরাঞ্চলগুলোতে এই চিত্র আরো ভয়াবহ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ, সাহেবের আলগা, হাতিয়া, কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুরসহ ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার বিভিন্ন চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি চরের অধিকাংশ মানুষ নিকট শুকনো জায়গায় স্থান না পেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে নৌকা ও ভেলায় বসবাস করছে।

শুধু মাত্র ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার প্রায় ২ শতাধিক দুর্গম চরাঞ্চলের প্রায় ৫ হাজার পরিবার ১০ থেকে ১২ দিন ধরে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া বাড়ি ঘরের পাশেই নৌকায় বসবাস করছেন।

সরেজমিনে বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালের চর ও বালা ডোবার চর ঘুরে দেখা গেছে, এসব চরে ৬ শতাধিক পরিবারের বসবাস। এদের মধ্যে যাদের নৌকা নেই সেসব পরিবার দুরবর্তী উঁচু স্থানে ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে স্থান নিলেও বেশির ভাগ পরিবার নৌকায় সংসার পেতেছে। প্রত্যেকটি ১৮ থেকে ২০ হাত ডিঙ্গি নৌকায় বসবাস করছেন একেকটি পরিবারের ৬ থেকে ৯ জন সদস্য। সেখানেই তাদের রান্না-বান্না, নাওয়া-খাওয়া ও প্রাকৃতিক কাজ সম্পাদন করাও। বাড়ির আশে-পাশেই জোট বদ্ধভাবে কয়েকটি করে পরিবার এক সঙ্গে পাশাপাশি নৌকায় অবস্থান নিয়েছেন। ইঞ্জিন চালিত যে কোন নৌকার শব্দ শুনলেই এসব পরিবার ত্রাণের আশায় নৌকা নিয়ে ছুটে আসেন সেই নৌকার কাছে।

আরো পড়ুন>> কুড়িগ্রামে ৭ লাখ মানুষ পানি বন্দি

মশালের চরে নৌকায় বসবাসকারী পরিবারের একজন আজাহার আলীর ছেলে মাইদুল ইসলাম জানান, বাড়িতে বন্যার পানি উঠায় এবং নিকটবর্তী উঁচু কোন জায়গা না থাকায় বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ৯ দিন যাবৎ এই নৌকায় বসবাস করছি। এ অবস্থায় বৃদ্ধ বাবা-মা ও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয় সব সময়। নৌকায় চাল, ডাল থাকলেও শুকনো খড়ির অভাবে ঠিক মতো রান্না করে খাওয়াতে পারছি না। নৌকাতে পরিবার থাকায় বাজার গিয়ে শুকনো খাবার কিনে আনবো সেটারও কোন পথ নেই।

একই চরে নৌকায় বসবাসকারী আমিনা বেগম জানান, এই ছোট নৌকায় পরিবারের আট সদস্য মিলে বসবাস করছি। এখানে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে প্রাকৃতির কার্যকলাপ সম্পাদন করা। পাশাপাশি এলাকার সকল নলকূপ তলিয়ে থাকায় বন্যার পানিই খাওয়াসহ রান্না-বাড়ার কাজও সারতে হচ্ছে।

এভাবে নৌকায় বসবাসকারী অনেক পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চারিদিকে থৈ থৈ পানি থাকায় কোন কাজ জুটছে না। আর যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে তাদের নৌকাটিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করায় মাছ ধরে বিক্রি করতেও পারছেন না তারা। অনেক পরিবারের ছোট ছোট বাচ্চারা ডায়রিয়া ও জ্বরসহ নানা পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এসব পরিবার রান্নার অভাবে একবেলা খেয়েই দিন পার করছেন। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষা প্রহর গুনছে এসব পরিবারগুলো।

বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ৯ নাম্বার ওয়ার্ড মশালের চরের ইউপি সদস্য আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, আমার ওয়ার্ডে মোট মোট ৬শ পরিবার এদের মধ্যে ৩ শতাধিক পরিবার নিকটবর্তী কোন শুকনো জায়গায় স্থান না পেয়ে নৌকায় বসবাস করছে। এই পরিবারগুলো দীর্ঘ ১০ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত পরিবারের ৪ থেকে ৫ জন করে সদস্যকে নিয়ে নৌকায় বসবাস করছে। এরমধ্যে অধিকাংশ পরিবারকে এ পর্যন্ত মাত্র ১০ কেজি করে চাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। আবারও ত্রাণের চাল পেলে বাকীদের দেয়া হবে।

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো: বেলাল হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নটি বহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় অবস্থিত। এই ইউনিয়নে কমপক্ষে ৬শ পরিবার ছোট ছোট নৌকায় বসবাস করছেন। নৌকায় বসবাসকারী বেশির ভাগ পরিবার তাদের মাছ ধরার নৌকায় সংসার পেতেছেন। এদের রান্না-বাড়া, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম সব নৌকাতেই। আর যাদের নৌকা নেই তারা দুরবর্তী উঁচু জায়গায় স্থান নিয়েছেন। প্রয়োজনের তুলনায় এসব পরিবারকে ত্রাণ দেয়া সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৯০ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সরকারী হিসাবে জেলার ৯ উপজেলায় বন্যা কবলিত প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষের জন্য ৮শ মেট্রিক টন জিআর, ৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

স্বাআলো/এম

.

Author