
নাজমুস সাকিব আকাশ, বাঘারপাড়া: ‘শিশির জমা দুর্বাঘাসে শশীর আলো পড়ে, দীপ্ত দ্যুতি ঝলমলিয়ে সবার মন কাঁড়ে।’ কবির এ কথার রেশ ধরেই যেন কার্তিকের শুরুতেই শীতের বার্তা এলো শিশিরে। শীতের শুরুতে খেজুরের রস, গুড় ও পাটালির স্বাদ নিতে উদগ্রীব হয়ে থাকে দেশের মানুষ। আর নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস খেতে গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের সমাগম ঘটে। দিন বদলের সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেলেও যশোরের খেজুর গুড় ও পাটালির কদর কমেনি। যে কারণে প্রবাদ আছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস।’ এখন এর চাহিদা ও সুনাম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে। শীতের ভরা মৌসুম না এলেও এরই মধ্যে রস সংগ্রহের জন্য গাছিরা খেজুর গাছ পরিচর্যা শুরু করেছেন।
তবে বিভিন্ন পেশা বংশ পরম্পরায় চললেও গাছিদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। গাছির ছেলে হচ্ছেন না গাছি। অবৈধ ইটভাটার আগ্রাসনে দিন দিন কমছে খেজুর গাছের সংখ্যা। যে কারণে এ বছরও চাহিদা অনুযায়ী রস পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন গাছিরা।
খেজুর গুড় ও পাটালি তৈরির মূল কেন্দ্রবিন্দু জেলার খাজুরা অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, মৌসুম শুরু না হতেই এখানে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়েছে। যারা গাছ কাটায় পারদর্শী তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় ‘গাছি’ বলা হয়। তারা কোমরে শক্ত মোটা দড়ি বেঁধে গাছের মাথায় উঠেন। পিঠে ঝুলানো ঠুঙিতে থাকা ধারালো গাছিদা (দা) দিয়ে গাছের এক পাশের ডাল কেটে বের করছেন সোনালী অংশ। যাকে স্থানীয়রা চাঁচ দেয়া বলেন। এর সপ্তাহ খানেক পরেই বাঁশের তৈরি নলি স্থাপন শেষে ঠিলে (মাটির ভাড়) পেতে রস সংগ্রহ করা হবে। সব মিলিয়ে আগামী মাসের শুরুতে সুস্বাদু খেজুর রস আহরণ করবেন এখানকার গাছিরা।
জানা যায়, যশোর সদরের লেবুতলা ও ইছালী এবং বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ও জহুরপুর ইউনিয়ন নিয়ে খাজুরা অঞ্চল। খেজুর গাছের আধিক্য থাকার কারণেই এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে ‘খাজুরা’। এর মধ্যে মোটাদানার বিশেষ পাটালি তৈরির জন্য লেবুতলা ইউনিয়নের বাওনডাঙ্গা ও তেজরোলের দেশব্যাপী সুখ্যাতি রয়েছে। এ গ্রামে যারা পাটালি তৈরি করেন এমন কারিগর দেশের আর কোথাও নেই।
বন্দবিলা ইউনিয়নের কঠুরাকান্দি গ্রামের গাছি আবুল কালাম বলেন, ‘৪০ বছর যাবৎ এ পেশার সাথে আছি। মৌসুমের শুরুতে রস সংগ্রহের কাজ শুরু করি। কাঁচা রস বিক্রির পাশাপাশি গুড় ও পাটালি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি।’
ধর্মগাতী গ্রামের গাছি আক্তার মোল্যা বলেন, ‘আগের তুলনায় খেজুর গাছের সংখ্যা অনেক কমেছে। নতুন করে গাছিও তৈরি হচ্ছে না। আর যারা গাছি আছেন তাদের অধিকাংশই বয়সের ভারে আর গাছে উঠতে পারেন না।’
সফল পাটালি উৎপাদনকারী লেবুতলা ইউনিয়নের তেজরোল গ্রামের নাজিম উদ্দীন বলেন, ‘মোটাদানার ১ কেজি পাটালি তৈরি করতে কমপক্ষে ২শ’ টাকার বেশী খরচ হয়। কিন্তু আশানুরুপ দাম দিতে চাই না ক্রেতারা। এলাকার কিছু অসাধু লোক অল্প গুড় উৎপাদন করে তাতে অধিক চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করে তা অল্প দামে বিক্রি করে থাকেন। এতে ভালো জিনিসের কদর থাকেনা। ফলে প্রকৃত গাছিরা এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সামাজিক সংগঠনের সভাপতি জানান, অবৈধ ইট-ভাটার আগ্রাসনে আগের তুলনায় এখন খেজুর গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বনবিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবাধে ভাটা মালিকেরা খেজুর গাছ ধ্বংস করে চলেছে। প্রাচীন এই ঐতিহ্য রক্ষায় সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
সদর ও বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সদরে ১০৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৮২টি এবং বাঘারপাড়ায় ২৬৫ হেক্টর জমিতে ৯২ হাজার ৭৫০টি খেজুর গাছ রয়েছে।
বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া আফরোজ বলেন, ‘গত বছর উপজেলার ৬০ জন গাছি নিয়ে একটি সংগঠন করা হয়। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও উৎসাহ বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সড়কের ধারে অর্ধশতাধিক খেজুরা গাছের চারা রোপণ হয়েছিলো। সেগুলো থেকে কয়েক বছর পরে রস সংগ্রহ করা যাবে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে চারা রোপণ করা গেলে খেজুর গাছের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব।’
জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান জানান, যারা খেজুর গুড় ও পাটালি তৈরি করেন, তাদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে। এ বছরেও ভেজাল রোধে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান চলবে। এছাড়া আসল গুড় ও পাটালির গুণাগুণ এবং ভেজালের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতনমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ড চালানো হবে বলে জানান তিনি।
স্বাআলো/এসএ
.
