নারিকেলের মালা দিয়ে তৈরি হচ্ছে হস্ত শিল্পের উপকরণ

মফিজ জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা: পরিবেশ থেকে সুবিধা নিচ্ছি, কিন্তু সুরক্ষায় উদাসিন। পরিবেশ রক্ষায় কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই ভাবনা থেকে পরিত্যক্ত নারিকেলের মালা দিয়ে তৈরি হচ্ছে হস্ত শিল্পের উপকরণ। এক সময় নারিকেলের মালা গুলো যত্রতত্র ফেলে রাখা হত ব্যবহারের পরে। সেখানে জন্ম নিত মশা। এ উদ্যোগ কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে চিত্র। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে বেশ কিছু বেকারের। মালা দিয়ে হস্ত শিল্পের পরিকল্পনা নেন তরুণ উদ্যোক্তা খালিদ বিন ওয়ালিদ। নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি হচ্ছে মনোমুগ্ধকর পাখির বাসা, সাবান দানি, ল্যাম্প সেড, লবন রাখা পাত্র, শোপিচ, গহনা, তৈজসপত্র, ফুলদানি, নৌকা, কলমদানি, হারিকেন, কেটলি, চামচ, কাপসহ প্রায় ২৫০ রকমের পণ্য তৈরি হচ্ছে। দেশের বাজারে চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে মালা দিয়ে তৈরি পণ্য গুলো। পণ্যর আকার ও মান ভেদে বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সাতগাড়ি পাড়ার বাসিন্দা খালিদ বিন ওয়ালিদ। তিনি পড়াশুনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। সেখান থেকে বিএসসি (সম্মান), এমএসসি পাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি কোর্স ছিল পরিবেশ রসায়ন। পরিবেশ রসায়ন ছিলো তার সব চেয়ে প্রিয় বিষয়। সেই থেকেই মাথায় চিন্তা আসে পরিবেশ নিয়ে কিছু একটা করতে হবে তরুণ প্রজেন্মের জন্য।

সেই থেকে শুরু পরিবেশ বান্ধব পণ্য নিয়ে কাজ করার। গবেষণা, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে চলা, তথ্য সংগ্রহ করে সংরক্ষণ ও পর্যলোচনা। পরিত্যাক্ত নারিকেলের মালা দিয়ে পরিবেশ বান্ধব পণ্য তৈরির ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। সাতগাড়ি এলাকায় তৈরি করেন বড় একটি কারখানা।

খালিদ বিন ওয়ালিদ কারখানায় হস্ত শিল্পের পণ্য তৈরির কাজ করার জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শঙ্করচন্দ্র গ্রামের কাঠমিস্ত্রি আলামিন হোসেনকে প্রস্তাব দেন। কারণ আলামিন হোসেন ছিলেন একজন দক্ষ কারিগর। তাকে মালা দিয়ে তৈরি জিনিসপত্র তৈরির কাজ দেখানোর জন্য নিয়ে যায় বরিশাল বিভাগের কয়েকটি জেলায়। সেখান থেকে প্রাথমিক ধারণা নেন কাজের। এরপর অল্প পরিসরে কারখানায় কাজ শুরু হয়। পরে ইউটিউবে বিভিন্ন ধরনের হস্ত শিল্পের কাজ গুলো দেখেন। কাজের মান যাচাই করা হয়। মার্কেটে ক্রেতাদের কাছে কেমন চাহিদা আছে।

২০১৮ সালে খালিদ বিন ওয়ালিদ বাণিজ্যিক ভাবে রোদো হ্যান্ডিক্যাফট নামের কারখানায় হস্ত শিল্প তৈরির কাজ শুরু হয়। যশোর ও খুলনা থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে নারিকেলের মালা কিনে আনেন কাজের জন্য। মালা গুলো পণ্য তৈরির জন্য হাতে ও মেশিনে প্রস্তুত শুরু করেন কারিগর। মালা দিয়ে পণ্য তৈরি করতে লাগে কাঠ, বাঁশ, সুতা, আঠা, বিভিন্ন রঙের বার্নিশসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ গুলো। মালা দিয়ে পাখির বাসা, সাবান দানি, ল্যাম্প সেড, লবন রাখা পাত্র, শোপিচ, গহনা, তৈজসপত্র, ফুলদানি, নৌকা, কলমদানি, হারিকেন, কেটলি, চামচ, ওয়াল মেট, কাপসহ প্রায় ২৫০ রকমের পন্য তৈরির কাজ শুরু করেন। মালা ও অন্য উপকরণ দিয়ে পণ্য তৈরির পর সেগুলো বার্নিশ দিয়ে রঙ করা হয়। পণ্য গুলোর সোন্দর্য ফুটে উঠে।

প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত কারখানায় এ উপকরণ প্রস্তুত করেন ৮-১০ জন কারিগর ও তার সহকারীরা। একজন কারিগর প্রতিদিন ৩-৪টি পণ্য তৈরি করতে পারেন। কারখানায় কাজ করা মানুষ গুলোর কর্মসংস্থান হচ্ছে।

দেশের বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে নারিকেলের মালা দিয়ে তৈরি পণ্য গুলোর। কারণ এ গুলো দেখতে সুন্দর ও গুণগত মান যে কোন পণ্যের চেয়ে ভাল। পণ্য গুলো সম্পর্ণ পরিবেশ বান্ধব। পণ্যের আকার ও মান ভেদে প্রত্যেকটি বিক্রি হয় ১০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা দরে। দেশের বাজারে চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়েছে। ইউরোপ ও এশিয়ায় পণ্য গুলো যাচ্ছে। প্রতি মাসে প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

নারিকেলের শাঁস তুলে নিয়ে মালা গুলো যত্রতত্র ফেলে দিত সাধারণ মানুষ। বর্ষাকালে মালা গুলোতে পানি জমে মশার বংশ বিস্তার হত। মশা বিভিন্ন রোগের জীবাণু বহন করে। মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এডিস মশা বিস্তারের একটি বড় কারণ। এ মশার কামড়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। মালা গুলো যেখানে সেখানে ফেলে না দিয়ে ব্যবহার উপযোগি করা যায় তাহলে মশার বংশ বিস্তার রোধ সম্ভব। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আবদান রাখছে। সাধারণ মানুষের ব্যবহার করছে ঘর সাজানোর জন্য।

কারখানা ম্যানেজার সবুজ সাবিদ বলেন, আমাদের উৎপাদিত পন্য গুলো বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ব্যবসায়ীরা। কারখানা থেকে কিনে নিয়ে যান। অনেকে আবার অন-লাইনের মাধ্যমে অর্ডার দেন। মালার তৈরি জিনিসের চাহিদা অনেক বেশি। অনেক তৈরি মাল রয়েছে।

কারিগর আলামিন হোসেন জানান, এ কাজ চোখে দেখে রপ্ত করি। মালিক সাথে করে নিয়ে যান বরিশালে। সেখানকার কারিগরদের কাজ দেখে আসি। ইউটিউভ দেখে জিনিস বানায়। ১০ হাজার টাকা বেতন পায় তা দিয়ে ভাল ভাবে সংসার চলছে।

রোদো হ্যান্ডিক্যাফটের পরিচালক খালিদ বিন ওয়ালিদ বলেন, পরিবেশ রক্ষা করতে এ উদ্যোগ। নারিকেলের মালা দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে দেশে ও বিদেশে বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা অনেক বেশি। অনেক বেকারের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে। মালা দিয়ে তৈরি উপকরণ গুলো দেখতে সুন্দর। প্রথমে লোকসান দিয়ে এ কারখানা চালু করতে হয়। বর্তমানে বিক্রি অনেক ভাল।

চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান জানান, পরিবেশ রক্ষায় তরুণ উদ্যোক্তা ভাল কাজ শুরু করেছেন। নারিকেলের মালায় মশার বসবাস। মালা ব্যবহারের কারণে পরিবেশ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। চুয়াডাঙ্গায় কুটির শিল্পের পণ্য তৈরি হচ্ছে। অন্য তরুণরা এ পেশায় সম্পৃক্ত হোক।

চুয়াডাঙ্গা বিসিকের উপ-পরিচালক সামসুজ্জামান বলেন, এটি ভাল উদ্যোগ। মালা দিয়ে কুটির শিল্পের বিভিন্ন উপকরণ তৈরি হচ্ছে। রোদো হ্যান্ডিক্যাফটসকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এখানে যে পণ্য গুলো উৎপাদন করা হয়, সেগুলো বাজারজাত করতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি কারখানাটি ঘুরে দেখেছি। এক সময় মালা গুলো ফেলে দেয়া হত।

স্বাআলো/আরবিএ

.

Author