
দেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাট। কয়েক বছর আগেও জেলাটির বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছিলো তামাকের একক আধিপত্য। নামমাত্র লাভের আশায় জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে দিনের পর দিন ক্ষতিকর তামাক আবাদ করে আসছিলেন চাষীরা। কিন্তু ভুট্টার লাভজনক আবাদ অবশেষে কৃষকদের মুক্তি দিয়েছে তামাকের সেই ভয়াবহতা থেকে। কম খরচে দ্বিগুণ লাভ হওয়ায় পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ভুট্টার চাষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময়োপযোগী নির্দেশনা আর পর্যাপ্ত প্রণোদনা নিশ্চিত করা গেলে লালমনিরহাটে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে ক্ষতিকর তামাকের চাষ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় মোট ৩১ হাজার ৫০৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। প্রায় দেড় লাখ কৃষক এসব জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায়।
কৃষি বিভাগ জানায়, গত ১০ বছর আগেও এসব জমিতে পুরোদমে তামাকের আবাদ হতো। ভুট্টা উৎপাদনে সফলতার এ গল্প আঁচ করা যায় লালমনিরহাটের ব্র্যান্ডিং স্লোগানেও। জেলার ব্র্যান্ডিং স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ভুট্টায় ভরা সবার ঘর, লালমনিরহাট স্বনির্ভর’।
আদিতমারী উপজেলার ভাদাই ইউনিয়নের চাষী আমিনুর রহমান বলেন, আমি দুই একর জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। প্রতি একরে প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে প্রতি একরে এক লাখ ৩৪ হাজার ৪০০ টাকার ভুট্টা বিক্রি হবে। এতে একর প্রতি ৭৪ হাজার ৪০০ টাকার মতো লাভ হবে। তিনি বলেন, দ্বিগুণ লাভ হওয়ায় স্থানীয়রা গত ১০ থেকে ১১ বছর ধরে ভুট্টা চাষ করছেন।
পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের খেংটি এলাকার কৃষক হামিদ মিয়ার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, গত ৯ থেকে ১০ বছর আগে আমাদের এলাকায় চারদিকে শুধু তামাক চাষ করা হতো। এখন আমাদের এলাকার যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই শুধু ভুট্টা আর ভুট্টা ক্ষেত দেখতে পাবেন। আর এর মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যও বদলে গেছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের পারুলিয়া এলাকার সফিয়ার রহমান বলেন, তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরের জমিতে ভুট্টার বিপ্লব ঘটে গেছে। কৃষক যেনো সোনা উৎপাদনের খনি পেয়েছে। এই চরে আমারও দুই একর জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। ভুট্টা আমাদের পরিবারে আর্থিক ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। ভুট্টা নিয়ে সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন।
এদিকে ভুট্টা চাষ লাভজনক হওয়ায় কমেছে তামাকের আবাদ। তবে পুরোপুরি তামাক চাষ বন্ধ করতে সরকারি-বেসরকারি প্রণোদনার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন একাধিক কৃষক।
তারা বলেন, সরকারিভাবে ভুট্টা চাষীদের ৪ শতাংশ হারে ঋণ প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও চাহিদার তুলনায় এটি খুবই অপ্রতুল। ফলে বেশিরভাগ কৃষকেরই এই সুবিধার আওতায় আসা সম্ভব হয়নি। অথচ তামাক কোম্পানিগুলো বিনা সুদে ঋণ সুবিধাসহ নানা প্রলোভন দিয়ে ফের কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করার টানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের চর রুদ্রেশ্বর এলাকার চাষি মালেক মিয়া বলেন, আগে আমরা তামাক চাষ করতাম। এই তামাকের গন্ধে বাড়িতে থাকা যেতো না। শিশুরা খুবই কষ্টে থাকত। এখন ভুট্টা চাষ করে আমরা অনেক ভালো আছি।
আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, আমরা চেষ্টা করছি তামাক নির্মূল করার। কিন্তু কিছু চাষীকে তামাক কোম্পানির লোকজন গোপনে টাকা দিয়ে তামাক চাষ করতে উদ্বুদ্ধ করছে বলে শুনেছি। এ সিন্ডিকেটকে ভাঙতে পারলে তামাক চাষ বন্ধ হয়ে যাবে।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, আমরা সরকারের তরফ থেকে চেষ্টা করছি তামাকের বদলে ভুট্টা, গম, সরিষা ও বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহী করতে। এজন্য বিভিন্ন প্রণোদনাও প্রদান করা হচ্ছে। এর মধ্যে পাটগ্রাম-হাতীবান্ধা এ দুই উপজেলায় ভুট্টা চাষে নীরব বিল্পব ঘটে গেছে। এখন কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষকরাও সেই পথে হাঁটছে। দুই-এক বছরের মধ্যে এ উপজেলায়ও তামাক চাষ কমে যাবে।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ বলেন, তামাক শুধু মানবদেহের জন্য ক্ষতিকরই নয়। এটি মাটির জন্যও ক্ষতিকর। খরচের তুলনায় কৃষকের আয়ও তেমন হয় না। তাই তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে আমাদের সব পক্ষকে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
তিনি আরো বলেন, তিস্তা চরে এবং জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা ও কালীগঞ্জ উপজেলায় ব্যাপক ভুট্টা চাষ হয়েছে। এসব অঞ্চলের কৃষকের উৎপাদিত ভুট্টা দিয়ে কৃষিনির্ভর কলকারখানা গড়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
স্বাআলো/এস
.
জেলা প্রতিনিধি, লালমনিরহাট
