চৌগাছায় ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে শিক্ষক পদে যোগদানের অভিযোগ

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় ভুয়া স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে বাবার কোটায় নিয়োগ পেয়ে যোগদানের অভিযোগ উঠেছে সম্রাট আলমগীর নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ওই শিক্ষার্থী এবং তার বাবার সকল কাগজপত্র এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশে প্রতিবেদনসহ তার দফতরে পাঠানো হয়েছে।

সম্রাট আলমগীর ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার মান্দারবাড়িয়া ইউনিয়নের আলীশাহ যদুনাথপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তাহাজ্জত হোসেনের ছেলে। তাহাজ্জত হোসেন আলীশাহ যদুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসরে রয়েছেন।

সম্রাট আলমগীর চৌগাছা উপজেলার স্বরুপদাহ ইউনিয়নের স্বরুপদাহ গ্রামে নিজের স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে বাবার প্রাথমিক শিক্ষক কোটায় চাকুরি নিয়েছেন। নিয়োগ ও যোগদানের কাগজপত্রে বাবার নাম তাহাজ্জত হোসেন এবং মায়ের নাম চায়না বেগম গ্রাম ও ডাকঘর স্বরুপদাহ, উপজেলা চৌগাছা, জেলা যশোর দেখিয়েছেন। গত ২৪ জানুয়ারি বিদ্যালয়ে যোগদানের পর বিশেষ শাখার পুলিশ সদস্যরা ভেরিফিকেশন করতে গ্রামে খোঁজ খবর নিলে সম্রাট যে স্বরুপদাহ গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন সেটি প্রকাশ্যে আসে।

যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করে সম্রাট আলমগীর চাকুরি পেয়েছেন ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক সোহেল আহমেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় নিম্নলিখিত শর্তে আবেদন আহবান করা যাচ্ছে। এই শর্তসমূহের ৮ নম্বরে বলা হয়েছে, ‘আবেদনকারী যে উপজেলার/যে থানার স্থায়ী বাসিন্দা তার প্রার্থিতা উক্ত উপজেলা/থানার অনুকুলে নির্ধারিত থাকবে এবং তার নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম তদনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৯ এ বর্ণিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী নির্বাচিত প্রার্থীকে নিজ উপজেলা/থানায় নিয়োগ দেয়া হবে।

বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে ১০ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, ‘বিবাহিত মহিলা প্রার্থীগণ আবেদনে তাদের স্বামী অথবা পিতার স্থায়ী ঠিকানায় আবেদন করতে পারবেন। তবে এ দু’টি স্থায়ী ঠিকানার মধ্যে তিনি যেটি আবেদনে উল্লেখ করবেন তার প্রার্থিতা সেই উপজেলা/থানার কোটায় বিবেচিত হবে।

প্রাথমিকের শিক্ষক এবং নিয়োগ না পাওয়া অন্য প্রার্থীরা বলছেন, ১০ নম্বর শর্তানুযায়ী পুরুষ প্রার্থীরা শুধুমাত্র পিতার স্থায়ী ঠিকানায়ই আবেদন করতে পারবেন। অথচ তিনি অন্য উপজেলা এমনকি অন্য জেলায় পিতার স্থায়ী ঠিকানা হওয়া সত্বেও চৌগাছার স্বরুপদাহ গ্রামে স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়েছেন। আবার তার পিতা অন্য জেলার বাসিন্দা হওয়া সত্বেও তার কোটা ব্যাবহার করে মাত্র ৪১ নম্বর পেয়েও নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। অথচ স্বরুপদাহ গ্রামেই কয়েকজন প্রার্থী ৬২ বা ৬৩ নম্বর পেয়েও কোটা না থাকায় চাকরি পাননি। তাদের দাবি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে সম্রাট আলমগীর চৌগাছার একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর চাকরি বঞ্চিত করেছেন।

শর্তের ১২ নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে ‘অসত্য/ভুয়া তথ্য সম্বলিত/ত্রুটিপূর্ণ/অসম্পূর্ণ আবেদনপত্র কোন কারণ দর্শানো ব্যতিরেখে বাতিল বলে গণ্য হবে। প্রার্থী কর্তৃক দাখিলকৃত/প্রদত্ত কোন তথ্য বা কাগজপত্র নিয়োগ কার্যক্রম চলাকালে যে কোন পর্যায়ে বা নিয়োগপ্রাপ্তির পরেও অসত্য/ভুয়া প্রমাণিত হলে তার দরখাস্ত/ নির্বাচন/নিয়োগ বাতিল করা হবে এবং মিথ্য/ভুয়া তথ্য সরবরাহ করার জন্য তার বিরুদ্ধে আইনগত/প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া আবেদনে নিজ জেলা, থানা/উপজেলা ভুল করলে তার প্রার্থীতা বাতিল বলে গণ্য হবে।

এ বিষয়ে সহ-শিক্ষক পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং ভাইভা দিয়েও চুড়ান্ত নিয়োগ না পাওয়া গ্রামের অপর দুই প্রার্থী মুন্না ও আজগর আলী মোবাইল ফোনে জানান, এই নামে গ্রামের অন্য কেউ আছেন এটা তারা জানতেন না। পরে শুনেছেন এমন একজন গ্রামের ঠিকানায় চাকুরি পেয়েছেন। তারা বলেন, ছেলে ও মেয়ে মিলে গ্রামের মোট ১২ জন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভাতে অংশ নেন। এদের মধ্যে দুজনের চাকরি হয়েছে বলে তারা জানতেন। তবে পরে শুনেছেন এই গ্রামের একজনের ভাগ্নের চাকরি হয়েছে। তবে গ্রামে থেকে সে লেখাপড়া করেছে বা এই গ্রামে সে থাকতো এমনটা তারা কখনো শোনেননি বা জানেন না।

গ্রামের বর্তমান ইউপি সদস্য ফখরুল ইসলাম বলেন, সম্রাট আলমগীর নামে গ্রামে কেউ তাহাজ্জত হোসেনের ছেলে নেই। তিনি বলেন, শুনেছি গ্রামের একজনের ভাগ্নের (বোনের ছেলে) এই নামে চাকরি হয়েছে। তিনি বলেন, এমন কারো আমি স্থায়ী নাগরিক হিসেবে কোন প্রত্যয়নপত্র দিইনি।

গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলাম বাবু বলেন, এই নামে কোন ছেলে গ্রামে নেই। তবে পরে শুনেছি অন্য গ্রামের একজন এই গ্রামের একজনের নাতীর (মেয়ের ছেলে) চাকরি হয়েছে।

স্বরুপদাহ গ্রামের বাসিন্দা উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক এবং আরেকটি বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষকও সম্রাট আলমগীর যে গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন সে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

পুলিশ ভেরিফিকেশনের দায়িত্বে থাকা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) উপ-পরিদর্শক মাজহারুল ইসলাম বলেন, সম্রাট আলমগীর স্বরুপদাহ গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন, তিনি নানি বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করেছেন বলে জেনেছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ করে এ বিষয়ে ভেরিফিকেশন রিপোর্ট দেয়া হবে।

সম্রাট আলমগীর যে স্বরুপদাহ গ্রামের বসিন্দা নন, এই গ্রামে থেকে কখনো লেখাপড়াও করেননি তা তার একাডেমিক সার্টিফিকেট যাচাই করে এবং গ্রামের বর্তমান ও সাবেক ইউপি সদস্য, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অন্তত ১০ জনের সাথে কথা বলে এই প্রতিবেদক নিশ্চিত হয়েছেন। যার কল রেকর্ড রয়েছে।

স্বরুপদাহ ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল কদর এবং ইউপি সচিব সাধন চন্দ্র মোবাইলে জানান, সম্রাট আলমগীর ভুল বুঝিয়ে ইউনিয়নের নাগরিকত্ব সনদ নিয়েছেন। তারা জানান, এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানানো হবে।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ জানুয়ারি তিনি উপজেলার অন্য ৭৪ জন প্রাক-প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক পদে যশোর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগদান করেন। সেই তালিকার ৭২ নম্বরে সম্রাট আলমগীরের নাম রয়েছে। ২৩ জানুয়ারি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারী চৌগাছার চুটারহুদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদেন। এরপর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।

চৌগাছা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (টিও) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রাথমিক তদন্তে বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে মোবাইলে অবহিত করা হয়। তার নির্দেশে সম্রাট আলমগীর ও তার বাবার সকল কাগজপত্র প্রতিবেদন সহকারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। তিনি আরো বলেন, আলীশাহ যদুনাথপুর স্কুলসহ ওই এলাকার পাঁচটি স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম চৌগাছার মধ্যে। তবে তাদের ভূমি, নাগরিকত্বসহ অন্যান্য সকল কার্যক্রম ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার মধ্যে। সে হিসেবে তিনি বাবার কোটা পাবেন। তবে সে কোটায় মহেশপুর উপজেলায় চাকরি করতে হবে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, এ বিষয়ে মৌখিকভাবে জেনে চৌগাছা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। তিনি প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

স্বাআলো/এসএস

.

Author
নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর