ভোক্তার কাছ থেকে মাসে ২৭০০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় করছেন এলপিজি ব্যবসায়ীরা

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) আদেশ অমান্য করে বিভিন্ন স্তরের এলপিজি ব্যবসায়ীরা ভোক্তার কাছ থেকে মাসে অন্তত ২৭০০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় করে নিচ্ছেন বলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।

এর মধ্যে কেবল আমদানি ও বোতলজাতকরণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোর কাছে যাচ্ছে বাড়তি ৯০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা যাচ্ছে ডিলার, পরিবেশক ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের কাছে।

গতকাল বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে এলপিজি অপারেটর, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি, ডিলার, ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় এমন তথ্য উঠে আসে।

ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে এই খাতের ব্যবসায়ীরা একটি কৃত্রিম পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বাড়তি মুনাফার পথ তৈরি করে রেখেছে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।

অপারেটরদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যেই সমস্যাগুলো আমি দেখছি, সেটা পরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে। সামনে রমজান আছে, যেন এই সুযোগে আপনারা আরেকটু ব্যবসা করে নিতে পারবেন।

এলপিজির বাজারে ভোক্তা স্বার্থ পরিপন্থি এসব তৎপরতার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে জানান সফিকুজ্জামান।

বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, যমুনা, ফ্রেশ, জেএমআই, বিএম এনার্জি, আইগ্যাস, ওরিয়ন গ্যাস, এনার্জিপ্যাক, ডেলটা এলপিজিসহ মোট ২৮টি কোম্পানি সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে এলপি গ্যাস বোতলে ভরার ব্যবসা করছে। দেশে বর্তমানে মাসে এক লাখ ২০ হাজার টন এলপিজির চাহিদা রয়েছে বলে এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ জানাচ্ছে।

ভোক্তা অধিদফতর বলছে, সবচেয়ে বেশি চালু ১২ কেজি সিলিন্ডার হিসাব করলে মাসে কেনাবেচা হচ্ছে ৯০ লাখ সিলিন্ডার।

এলপিজির দাম মাসে মাসে নির্ধারণ করে দেয় বিইআরসি। ডিসেম্বরে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ছিলো ১২৯৭ টাকা। জানুয়ারি মাসে কমে হয়েছিলো ১২৩২ টাকা। গত বৃহস্পতিবার আবার দাম বাড়িয়ে ১৪৯৮ টাকা করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান উৎপাদন পর্যায়ে ১৪২৩ টাকা নেয়ার পরিবর্তে ১৫২০ টাকা করে নিচ্ছে।

সাধারণ ভোক্তাদের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য তুলে ধরে সফিকুজ্জামান বলেন, প্রতি সিলিন্ডারে ১০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে মিল গেইট থেকেই। আর ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে দাম ৩০০ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। ৯০ লাখ সিলিন্ডারে তাহলে প্রতিমাসে কত টাকা অতিরিক্ত লাভ হচ্ছে? আপানারাই হিসাব করে দেখেন।

তার হিসাবে, উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো মাসে ৯০০ কোটি টাকা এবং ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটররা আরো ১৮০০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় করে নিচ্ছে।

গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বরও এলপিজির বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণে কোম্পানিগুলোকে নিয়ে বসেছিলো ভোক্তা অধিকার। তখন যেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার কোনোটিরই সমাধান হয়নি। বুধবারের বৈঠকেও একই সমস্যা নিয়ে টানা দুই ঘণ্টা আলোচনার পর কোনো রায় আসেনি।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজের হতাশার বিষয়টি বার বার উঠে আসে ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালকের কণ্ঠে।

তিনি বলেন, আমরা অভিযান করে, কিছু সুপারিশ দিয়ে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখতে পেলাম না। ২২ সেপ্টেম্বর যে সমস্যা দেখেছি, এখনো একই সমস্যাই দেখতে পাচ্ছি। এমন নয় যে বছরে একবার দাম ঠিক করা হয়। প্রতি মাসে মাসে দাম ঠিক করা হয়। তারপরেও বাজারের এই পরিস্থিতি।

অনুষ্ঠানে বাড়তি দাম নেয়ার বিষয়ে বৃহৎ অপারেটরগুলোর প্রতিনিধিরা কিছু যুক্তি তুলে ধরেন।

বসুন্ধরা এলপিজির প্রতিনিধি জাকারিয়া জালাল বলেন, গত সেপ্টেম্বরের বৈঠকের পর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে ১০ থেকে ১২ বার চিঠি দিয়েছেন তারা আরেকটি গণশুনানি করার জন্য। কিন্তু সাড়া পাননি।

এখন যে গণশুনানির উপর ভিত্তি করে দাম ঘোষণা করা হয়, তা সম্পূর্ণ অবাস্তব আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ডিজেলের দামের তারতম্যের কারণে প্রতি সিলিন্ডারে কতটা প্রভাব পড়েছে, সেটা তো বিইআরসির মূল্য নির্ধারণীতে নেই। এর বাইরে গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম যে পরিবর্তন হয়েছে, সেগুলোও নেই। এক বছর আগে কর্মীদের যে টাকা বেতন দেয়া হতো, এখন কি সেই ভাবেই দিচ্ছি, নাকি আরো বেশি দিচ্ছি? সেটা মূল্য ঘোষণায় নেই। এরকম অনেকগুলো রিয়েল সিনারিও কস্ট ফর্মুলায় অনুপস্থিত।

পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের বিভিন্ন দাবির উত্তরে তিনি বলেন, ডিস্ট্রিবিউটররা বলেছেন, তারা ১৫২০ টাকা করে সিলিন্ডার কিনেছেন। কিন্তু এর মধ্যে যে তারা ট্রান্সপোর্ট, এক্সপ্লোসিভ, সেলস, স্পেশালের নামে ৮০ টাকা করে ইনসেনটিভ পান, সেটা তারা বলেনি। এই ৮০ টাকা বাদ দিলে গ্যাপটা কত থাকে? খুব বেশি পার্থক্য হয় না।

বেক্সিমকো এলপিজির চিফ মার্কেটিং অফিসার মেহেদী হাসান বলেন, গত দুই মাসে জাহাজ ভাড়া প্রতি টনে ৯৫ ডলার থেকে বেড়ে ১২০ ডলার হয়েছে। এই গ্যাপটা মিটিগেট করলে ভোক্তারা সঠিক মূল্যে এলপিজি পাবে। সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ টাকার একটা গ্যাপ বিদ্যমান। দোকানদারের জন্য ৩৮ টাকা লাভের মার্জিন। বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় এটা কোনোভাবেই পোষায় না। তাদের মার্জিনটা বাড়ানো দরকার। বিইআরসির মূল্য ঘোষণায় দোকানিদের লাভের মার্জিন আরো বাড়াতে হবে।

এই সময় ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, যত যুক্তিই দিন, ভোক্তার পকেট থেকে যে প্রতি সিলিন্ডারে ৩০০ টাকা করে বেশি বেরিয়ে যাচ্ছে, তা জাস্টিফাই করা যাচ্ছে না।

মেঘনা এলপিজির প্রতিনিধি মাহবুবুল আলম বলেন, গত পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে শিপ বঙ্গোপসাগরে এসে বসে আছে। কিন্তু এলসি জটিলতার কারণে এখনো পণ্য আনলোড করা যাচ্ছে না। এই আটদিন যে বিলম্ব হলো, তাহলে এই আট দিন আমরা সরবরাহ কীভাবে দেবো? সে কারণে এখন বাজারে পণ্যের স্বল্পতা আছে।

বিএম এনার্জির জিএম আলোক কুমার পন্ডিত বলেন, ১৫২০ টাকার মধ্যে আমি আমার ডিস্ট্রিবিউটরকে সব মিলিয়ে ১০০ টাকা ইনসেনটিভ দিচ্ছি। তাহলে আমার গ্যাস কেন ১৭০০ টাকা, ১৮০০ টাকায় বিক্রি হবে?

অনুষ্ঠানে একজন খুচরা বিক্রেতা বলেন, ওমেরা, বিএম যেটাই পাই ১২ কেজির বোতল ১৫৫০ টাকা করে কিনি। সেখান থেকে পিকআপ ভাড়া করে নিয়ে আসতে হয়। প্রতি বোতলে পড়ে আরো ৩০ টাকা। দোকান ভাড়া, স্টাফ খরচসহ আরো৫০ টাকা যায়। সব মিলিয়ে ১৬৩০ টাকা আমাদের খরচ পড়ে যায়।

ঢাকার মিরপুরের এলপিজি বিক্রেতা নাজিম বলেন, ১২ কেজি সিলিন্ডার ১৫২০ টাকা করে কিনে ১৫৮০ টাকা করে আমরা বিক্রি করি। এর কারণ হচ্ছে বাজার ক্রাইসিস থাকলে একটা গাড়ি প্ল্যান্টে গিয়ে ২/৩ দিন বসে থাকে। একদিন বসে থাকলে ২০০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। ঘোড়াশালে ওমেরার ডিপো থেকে আমি নিয়ে আসি।

অপারেটরগুলো মূল্য নির্ধারণে বিইআরসির রক্ষণশীল ভূমিকাকে দায়ী করলেও পাল্টা অপারেটরগুলোর বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ আনেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সচিব খলিলুর রহমান খান।

তিনি বলেন, উনারা বিবেকের কথা বলেছেন, আমি বিবেক থেকে শুরু করছি। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অনুযায়ী প্রতি টন এলপিজির দাম হচ্ছে ৭৯০ ডলার। উনাদের বক্তব্য অনুযায়ী যে কারণেই হোক এই মূল্যের এলপিজি এখনো দেশে ঢোকেনি। তাহলে উনারা এখন যে পণ্যগুলো বিক্রি করছেন, এগুলোর কেনা মূল্য কত? আগের কেনা ৫৯৯ ডলার মূল্যের পণ্য আছে। তাহলে তারা এত বেশি দামে বিক্রি করবে কেন? ১২৩২ টাকার পণ্য এখন ১৪৯৮ টাকা ঠিক করা হলো, সেটা বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ টাকায়।

গণশুনানির উদ্যোগ না নেয়ার অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, গণশুনানি তো উনাদের কোনো মৌখিক কথায় হবে না। কাগজপত্র, স্টেটমেন্ট দিতে হবে। আমরা বার বার চিঠি দিয়েছি, উনারা কোনো ডকুমেন্টারি স্টেটমেন্ট দেন নাই। উনারা সময় চেয়েছেন ১৬ মার্চ ২০২৩ তারিখে ডকুমেন্ট দেবেন। উনাদের জন্য তো আর মূল্য ঘোষণা থেমে থাকবে না। উনাদের যে বাড়তি খরচ হচ্ছে সেটার কাগজ যদি না দেন, তাহলে আমরা কীভাবে বুঝব? উনারা আরেকটা কথা বলেছেন, সেপ্টেম্বরের ভোক্তা অধিকারের নির্দেশনা মানা হয়নি। এটাও ঠিক নয়। কারণ সেপ্টেম্বরে প্রিমিয়াম ছিল ৮৫ টাকা, সেটা এখন ১০৬ টাকা ধরা হচ্ছে। একইভাবে ডিজেল অ্যাডজাস্ট করা হয়েছে। তবুও তারা যদি সরকার নির্ধারিত দাম না মানে সেটা তাদের ব্যাপার। তাদের মুখের কথায় তো আর দাম বেড়ে যাবে না।

ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের প্রতিনিধি কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, উনাদের (অপারেটর) বক্তব্য অনুযায়ী যেভাবে ইনসেনটিভের কথা বলা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এটা প্রতিযোগিতার বাজার। সেই প্রতিযোগিতার বাজারে তো ভোক্তাই লাভবান হওয়ার কথা। তবুও ভোক্তা আজ নির্ধারিত মূল্যে পণ্য না পেয়ে অধিক মূল্য দিতে হচ্ছে। বিপণন ব্যবস্থায় যেই সংকট, সেই সংকটটাকে বিইআরসি কীভাবে অ্যাড্রেস করছে, আমি জানতে চাই। অধিক মূল্যে ডিও হচ্ছে। ডিস্ট্রিবিউটর ও ডিলাররা তাদের কমিশন বেশি নিচ্ছে।

ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, আপনারা যেটা বলতে চাচ্ছেন যে, বিইআরসি দাম বাড়িয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে, সেটাও কিন্তু হচ্ছে না। কারণ একমাসের ব্যবধানে ২৬৬ টাকা দাম বাড়ানোর পরও তার উপর আপনার আরো ২/৩শ টাকা বাড়িয়ে দিলেন। বিইআরসির দাম বাড়ানোর প্রভাব বাজারে পড়ছে না। বোঝাতে চাচ্ছি যে, আপনার সেই মূল্য তালিকা অনুসরণ করছেন না।

স্বাআলো/এসএ

.

Author
ঢাকা অফিস