
আমি তখন সবে স্কুলের ছাত্র। পুরান ঢাকার পোগজ স্কুলে পড়ার সময়ই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। শৈশব থেকেই আমার বক্তৃতা শোনার প্রতি আগ্রহ ছিলো।
বঙ্গবন্ধু রাজধানীর আউটার স্টেডিয়ামে বক্তৃতা দিতেন, আমি প্রায়ই সেখানে গিয়ে বক্তৃতা শুনতাম। এক সময় যেখানে গুলিস্তান সিনেমা হল ছিলো, সেখানে আমি ও আমার বন্ধুরা দল বেঁধে যেতাম। সেখানে প্রায়ই দেখতাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বক্তৃতা করছেন। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম তার কথা। আর অপেক্ষা করতাম আর কে কে বক্তৃতা দেয়। তখন তো তেমন কাউকে চিনতাম না।
একদিন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বক্তৃতা শুনতে দাঁড়ালাম। একে একে আরো নেতা কথা বলবে।…শুনলাম দরাজ কণ্ঠে একজন বক্তৃতা দিচ্ছেন। বলছেন এদেশের ক্ষুধার্ত মানুষ ও এদেশের জনগণের অধিকার নিয়ে। কণ্ঠ শুনেই চমকে গেলাম। তার বলার ভঙ্গিও আলাদা। সাধারণ পলিটিশিয়ানদের মতো না। তাঁর কণ্ঠ শুনে ঠিক মনে হলো আরে ক্ষুধার্ত তো তিনিও থাকেন। তখন আমার এই বক্তৃতা দেয়া লোকটিকে দেখার, তার কাছে যাবার প্রবল ইচ্ছে হলো। সামনে গিয়ে দেখি চশমা পরা দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন। তাঁকে দেখে আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম – এই যে, বক্তৃতা দিচ্ছেন কে তিনি? সেই লোকটি আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন- মুজিব ভাই। আমাদের মুজিব ভাই।
এরপর থেকেই আমি ধীরে ধীরে শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যাওয়া শুরু করলাম। কোনো কিছু পাবার আশা নেই। কিন্তু তার বক্তৃতা শুনতে ভাল লাগতো। জাদুর মতো টানতো। শেখ মুজিবের যে কোনো মিটিংয়ের খবর পেলেই আমি সেখানে গিয়ে হাজির হতাম।
দেশে পৌঁঁছেছে নায়ক ফারুকের লাশ
এমনকি মাঝে মাঝে শেখ মুজিবের বক্তৃতা দেয়ার স্টেজেও উঠে যেতাম। পরে ধমক খেয়ে আবার নামতাম। তবুও যাওয়া থামাতাম না। মাঝে মধ্যে চেয়ার সরানো, চেয়ার ঠিকঠাক করা শুরু করলাম। কিছু একটা করতে হবে তো! আমার উদ্দেশ্য একটাই – তা হলো যে করেই হোক ঐ নেতার নজরে পড়তে হবে। যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। সাধনা করলে যে, যে কোনো কিছু পাওয়া যায়। তা সত্যি হলো জীবনে।
আমি বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে মোহাবিষ্ট হয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মিটিংয়ে ১৫-২০ জন ছেলে গিয়ে স্লোগান গান দিতাম আমরা। আমি প্রমাণ করতে চাইলাম যে আমরাও মুজিবের লোক। দুপুরবেলা সবাইকে পরোটা-মাংস খাওয়াতেন। সেটারও একটা লোভ ছিলো- যে আজ ভাল কিছু খাওয়া যাবে। ছেলেগুলোকে নিয়ে মিটিং শেষ করে বঙ্গবন্ধুর কাছে টাকা চাইলাম। তখন প্রথম বঙ্গবন্ধু আমাকে চিনলেন। কারণ প্রতিটি সভায় তিনি আমাকে দেখতেন। বুঝতে পারলেন আমি নাছোড়বান্দা। আমি তো কিশোরদের নিয়ে একদল হয়ে এসেছি । বললেন, তোর কীরে? বললাম- আমার ১৫ জন। খরচা লাগে না? বঙ্গবন্ধু হাসলেন। দুই-চার-পাঁচ টাকা সব সময় দিতেন। সেদিন প্রথম ৫ টাকা পেলাম। তখনকার এ টাকা অনেক।
এরপর একবার বঙ্গবন্ধুর পকেট মারতে গিয়ে ধরা খেলাম। বসে আছেন, ওনার পাঞ্জাবির পকেটে দেখি টাকা দেখা যায়। আস্তে করে দুই আঙুল যেই দিলাম উনি খপ করে আমার হাত ধরে ফেললেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- তোরে না দিলাম টাকা? আমি বললাম, দিছেন তো, কিন্তু টাকা দেখলে তো আর ভালো লাগে না! বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ ধমক দিয়ে আরো কিছু টাকা দিতেন। এ ঘটনা আমার প্রায় মনে পড়তো। এই ঘটনাটা আমি আমার একটি ছবির সিকোয়েন্সেও রেখেছিলাম পরবর্তীকালে। এরপর তার সান্নিধ্য পেলাম। অনেক কিছু বললেন। বোঝাতেন। আসলে আমি হয়তো উচ্ছন্নে চলে যেতাম। বঙ্গবন্ধুই আমাকে মানুষ করেছেন।
স্বাআলো/এস
.
ঢাকা অফিস
