
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে- এমন খবরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার রীতি পর্যালোচনা করে স্পষ্ট হওয়া গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত নিষেধাজ্ঞা দেয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে, মানবাধিকার ইস্যুতে বা গুরতর কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি বা বড় ধরনের কোনো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত হলেই। অন্যথায় শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করা বা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি কৌশলকে নাকচ করে দেয়ার কারণে কেউ নিষেধাজ্ঞা দেয় না।
একটি দৈনিকে আজ বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীনবিরোধী শক্তিশালী বলয় তৈরি করতে এবং ইউনূসকে নিয়ে তৎপর হওয়ার কারণে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিবে। কিন্তু এ সমস্ত কোনো কারণেই যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র কোনো একক সিদ্ধান্তে পরিচালিত একটি রাষ্ট্র নয়। এখানে সরকারের তিনটি অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য রয়েছে, জবাবদিহিতা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি যা ইচ্ছা তাই যেমন করতে পারেন না, তেমনি কংগ্রেসেরও স্বেচ্ছাচারি ক্ষমতা নেই। একজন রাষ্ট্রদূত তার পরিধির বাইরে গিয়ে কাজ করলে, তাকেও জবাবদিহি করতে হয়। এখানে সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং নানা রকম বিধিনিষেধ সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবহিত।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা এবং র্যাবের ওপর ২০২১ সালে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র। এই নিষেধাজ্ঞার প্রধান কারণ ছিলো মানবাধিকার লঙ্ঘন। একজন কাউন্সিলরকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার অভিযোগে তারা তদন্ত করেছিল এবং এই তদন্তে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত যথাযথ জবাব দেয়া হয়নি। জবাবগুলো এড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এ ব্যাপারটি নিয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল, সে কারণেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এসেছিলো।
কিন্তু ২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। আর এ বছর এখন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কোনো ধরনের প্রক্রিয়াই নেই বলে জানা গেছে। ওই সময় নিষেধাজ্ঞার পেছনে বড় কারণ ছিলো আমাদের সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের অকর্মণ্যতা, দায়িত্বহীনতা এবং ব্যর্থতা। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মার্কিন দূতাবাসে একাধিকবার তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ওই দূতাবাসে সেই সময়ে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন একজন জামায়াত শিবিরের ক্যাডার। যে কারণে তিনি কোনো তথ্য সরবরাহ করেননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন যেন বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে।
ওই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু কিছু বিষয় জানতে চেয়েছিলো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলো। দুই মন্ত্রণালয়ে চিঠি চালাচালি হতে হতেই আর যুক্তরাষ্ট্র কোনো জবাব পায়নি। এখন বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রকাশ্যে যা-ই বলুক না কেন, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি যোগসূত্র আছে। একপক্ষ আরেক পক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে। বিশেষ করে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দুতাবাস এখন সক্রিয় এবং তারা পুরো বিষয়টি নজরদারিতে রেখেছে। আর এ কারণেই হুটহাট করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে না।
এমনকি গত বছর বাংলাদেশের সম্পর্কে মানবাধিকার রিপোর্টেও বলা হয়েছে, র্যাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে এসেছে বলেও মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিলো। এই বাস্তবতায় এমন কোনো মানবাধিকারের অবনতি ঘটেনি যে নিষেধাজ্ঞা দিবে।
নির্বাচন নিয়ে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে একজন কূটনীতিক বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনই নির্বাচনের আগে নিষেধাজ্ঞা দেয় না। সম্প্রতি নাইজেরিয়ায় নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সেখানে কয়েকজন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ না হয় এবং সেই নির্বাচন যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলেও যুক্তরাষ্ট্র হয়তো কিছু কিছু পদক্ষেপ নিবে এবং সেটি হয়তো নির্ভর করবে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে হয়, তার ওপর।
একাধিক সূত্র বলছে, এছাড়াও কিছু কিছু কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। যেমন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যদি কেউ জড়িত থাকে, যদি কোনো রাষ্ট্র জড়িত থাকে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। কোনো সরকারকে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে হুমকি, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জন্য একটি সরকার ক্ষতিকারক, তাহলে তারা নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।
কিন্ত এগুলো দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার ব্যাপার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে একটি সমন্বিত পারস্পরিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এক ব্যক্তি চাইলেই সবকিছু করতে পারে না। কাজেই হঠাৎ করেই বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কথাটি শ্রেফ একটি গুজব বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা। কারণ এর আগেও বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসছে এমন জুজুর ভয় দেখানো হয়েছিলো সরকারকে কোনঠাসা করবার জন্য। এখন আবার নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কারা, কেনো আনছে- সেটি খতিয়ে দেখা দরকার বলেই মনে করেন কূটনীতিক বিশ্লেষকরা।
স্বাআলো/এসএ
.
ঢাকা অফিস
