আকাশপথে বাংলাদেশের সংযোগ আরো দৃঢ় করবে দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প রাজধানী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল (টার্মিনাল-৩)। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলে হচ্ছে এর নির্মাণ। আগামী ৭ অক্টোবর স্বপ্নের এ টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরই মধ্যে এ ঘোষণা দিয়েছেন বেবিচক চেয়াররম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। প্রকল্পের মোট নির্মাণ ব্যয় ঠেকবে ২৪ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের কাজের পরিধি বাড়ছে। এ কারণেই মূলত বাড়ছে ব্যয়। প্রাথমিকভাবে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত ছিলো। সেই সংখ্যা এখন বেড়ে দাঁড়াবে ২৬টি। এছাড়া আরো কিছু কাজের পরিধি বাড়ছে। এসব কারণেই বৃদ্ধি হচ্ছে ব্যয়।
বেবিচক সূত্র জানায়, শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর। সে সময় ব্যয় ধরা হয়েছিলো ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। পরে আরো ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়িয়ে প্রকল্পের আকার দাঁড়ায় প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। নতুন করে তিন হাজার কোটি টাকা বাড়লে প্রকল্পের ব্যয় হবে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির নির্মাণ শুরু হয়।
এ খরচের বেশিরভাগ আসছে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকার কাছ থেকে। সংস্থাটি ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বাকি ৫ হাজার ২৫৮ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। জুলাই ২০২৬ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হবে জুন ২০২৫ নাগাদ।
বেবিচক জানায়, প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি বেবিচকের একার সিদ্ধান্ত নয়। এর সঙ্গে বেবিচক, পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), উন্নয়ন সহযোগী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), অর্থ বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়া হবে। এরপরই মূলত বৃদ্ধি করা হবে প্রকল্পের ব্যয়।
যদিও ২০২০ সালের ৯ আগস্ট নির্মাণকাজ পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেছিলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনালের বিদ্যমান নকশায় কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। নির্মাণস্থানের মাটির অবস্থার কারণে স্ক্রুড পাইলিংয়ের পরিবর্তে বোর পাইলিংয়ে কাজ হচ্ছে। এটি একান্তই একটি টেকনিক্যাল বিষয়। এর কারণে প্রকল্প ব্যয় কোনোভাবেই বৃদ্ধি পাবে না বরং মোট প্রকল্প ব্যয় হতে ৭৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। সাশ্রয়কৃত টাকা দিয়ে সরকার ও জাইকার সম্মতি এবং অন্যান্য বিধিগত প্রক্রিয়া নিষ্পত্তি সাপেক্ষে তৃতীয় টার্মিনালে নির্মিতব্য ১২টি বোর্ডিং ব্রিজের অতিরিক্ত আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ এবং একটি ভিভিআইপি টার্মিনাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
শাহজালালে বর্তমানে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এ দুটি টার্মিনালের আয়তন এক লাখ বর্গমিটার। তৃতীয় যে টার্মিনালটি হচ্ছে, সেটির আকার বর্তমান দুটি টার্মিনালের দ্বিগুণের বেশি। দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার হবে এর আয়তন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় এর নির্মাণকাজ। প্রকল্প অনুমোদনের সিদ্ধান্ত অনুসারে, প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের এপ্রিলের মধ্যে। ঢাকা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে জাপানের মিত্সুবিশি ও ফুজিটা এবং কোরিয়ার স্যামসাং- এই তিন প্রতিষ্ঠান মিলে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ করছে।
থার্ড টার্মিনালে মোট ৩৭টি অ্যাপ্রোন পার্কিং থাকবে। ফলে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। শাহজালাল বিমানবন্দরে বর্তমানে ট্যাক্সিওয়ে আছে চারটি। নতুন করে আরো দুটি হাই স্পিড ট্যাক্সিওয়ে যোগ হচ্ছে। রানওয়েতে উড়োজাহাজকে যাতে বেশি সময় থাকতে না হয়, সেজন্য তৈরি করা হচ্ছে নতুন দুটি ট্যাক্সিওয়ে। এছাড়া পণ্য আমদানি ও রফতানির জন্য দুটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আরো থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলা ভবন।
বেবিচকের তথ্যানুযায়ী, থার্ড টার্মিনালে থাকবে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ। প্রথম ধাপে চালু করা হবে ১২টি। থাকবে উড়োজাহাজ রাখার জন্য ৩৬টি পার্কিং জোন। বহির্গমনের জন্য ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেকইন কাউন্টারসহ মোট ১১৫টি চেকইন কাউন্টার থাকবে। এছাড়া ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টারসহ থাকবে ৬৬টি ডিপারচার ইমিগ্রেশন কাউন্টার।
আগমনের ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেকইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি পাসপোর্ট ও ১৯টি চেকইন অ্যারাইভাল কাউন্টার থাকবে। এর বাইরে টার্মিনালে ১৬টি আগমনী ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হবে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে মাল্টিলেভেল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যবস্থা থাকবে এক হাজার ৩৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের।
এদিকে বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা এলাকায় এক্সপ্রেসওয়ের একটি লুপ নেমে গেছে নির্মাণাধীন থার্ড টার্মিনালে। টার্মিনালের প্রথম গেট এলাকায় আবার খোঁড়াখুঁড়ির কাজও চলছে। সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে টানেল। এ টানেল গিয়ে মিলবে বিমানবন্দরের অদূরে অবস্থিত মেট্রোরেলের স্টেশনে।
সবগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আর মেট্রোরেলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে বিমানবন্দর। ফলে বিদেশ থেকে যেসব যাত্রী আসবেন তারা খুব সহজেই বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে পারবেন। আবার যারা বিদেশ যাবেন, তারাও রাজধানীর যানজট এড়িয়ে খুব সহজে চলে যেতে পারবেন বিমানবন্দরে।
স্বাআলো/এসএ
.
