চিকন চালের চাহিদা মেটাবে ব্রি-৯৮ ধান

ফলন বেশি হওয়ায় বাড়ছে নতুন জাতের ধান ব্রি-৯৮ এর চাষ। খরচ কম, ফলন ভালো এবংরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। ধান সরু, চিকন ও চাল সাদা। বিঘা প্রতি ফলন ২০ থেকে ২২ মন। ব্রি-৯৮ ধান স্থানীয় খাটো বাবু ও ব্রি ধান ৪৮ এর বিকল্প হিসেবে আবাদ হবে, তবে সেচ সংকটের মাশুল দিতে হচ্ছে বলে দাবি করেন চাষিরা।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ মৌসুমে আউশ ধানের আবাদ হয়েছে ৪৩ হাজার ১৭ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৬ হাজার৫৫০ হেক্টর,আলমডাঙ্গায় ৮ হাজার ৭৬৭ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ১০ হাজার ৬০০ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ ধানের আবাদ হয়েছে। গত ৮ বছরের ব্যবধানে আউশের আবাদ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুনের ও বেশি। ২০১৪-১৫ মৌসুমে আউশ ধানের আবাদ হয়েছিল ২১ হাজার ৩২৫ হেক্টর। চলতি মৌসুমে আবাদ হয়েছে ৪৩ হাজার ১৭ হেক্টর জমিতে। আউশ মৌসুমে নতুন ব্রি-৯৮ ধান সরু, চিকন ও চাল সাদা হওয়ায় ধীরে ধীরে কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। গত বছরই প্রথম ১০ হেক্টর জমিতে এই ধানের আবাদ হয়েছিলো। চলতি মৌসুমেতা বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। কেবল আবাদ নয়, ব্রি-৯৮ ধানের গড় ফলনেও চুয়াডাঙ্গা জেলা সারাদেশে সেরাদের তালিকায় রয়েছে। গত বছর চুয়াডাঙ্গা জেলায় ব্রি-৯৮ ধানের গড় ফলন ছিলো হেক্টর প্রতি ৬.৭ টন ও চাল ৩.২ টন। চলতি মৌসুমে হিসেব করে দেখা গিয়েছে মাটি ভেদে হেক্টর প্রতি ৫.৫ টন থেকে ৬.৭ এবং চাল ৩.২ টন থেকে৩.৯৬ টন ।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার খেজুরতলা গ্রামের কৃষক আশাদুল হক জানান, আলমডাঙ্গা আইলহাঁস ব্লকের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আল হেলাল নান্নু এক প্যাকেট ব্রি-৯৮ ধানের বীজ এনে দিয়েছিলেন। আমি ১৬ দশমিক ৫ শতক জমিতে আবাদ করেছিলাম। ঐ জমি থেকে ১১ মন ধান পেয়েছি। এই ধান সরু, চিকন ও চাল সাদা হওয়ায় খওয়ার জন্য রেখে দিয়েছি।

একই উপজেলার দৌলাতদিয়াড় গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ জানান, আমি দুই বিঘা ব্রি-৯৮ ধানের আবাদ করেছিলাম। আমি ৪০মন ধান পেয়েছি । তিনি জানান, অন্য জাতের ধানের চেয়ে প্রায় ১৮০ টাকা বেশি দরে ১ হাজার ১৮০ মন দরে বিক্রি করেছি।

দামুড়হুদা কার্পাসডাঙ্গা মিশনপাড়ার মতিয়ার ভাটার ম্যানেজার লিটন মন্ডল জানান, প্রথমবারের মত ভাটায় ১২ বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন ব্রি ধান-৯৮ জাতটি। প্রচলিত সব জাতের তুলনায় ফলন বেশি ও আকার আকৃতিতে চিকন, বাজারে দাম ১৫০-১৮০ টাকা বেশি।

একই উপজেলার নতিপোতা গ্রামের কৃষক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এই মাঠে প্রায় ৩০০ বিঘা জমিতে নতুন ধান ব্রি-৯৮ জাতের আবাদ হয়েছে। তিনিও ৪ বিঘা জমিতে এই জাতের আবাদ করেছেন। আজ কর্তন করা হলো। তিনি জানান, ২২থেকে ২০ মন ফলন হবে। উপজেলা কৃষি অফিসের নির্দেশনায় সম্পূর্ণ ধান বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, আমি উপজেলার কৃষি অফিসের মাধ্যমে ব্রি-৯৮ ধানের বীজ এনে ৬ বিঘা জমিতে আবাদ করেছিলাম। তিনি বলেন, প্রায় ২০ মন হারে ফলন হয়েছে। কিছু ধান ১ হাজার ১০০ টাকা মন দরে বিক্রি করেছি। পূর্বে ধানের দাম বেশি ছিলো, বর্তমানে ধানের দাম কমে গিয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদা উপজেলার হাউলি ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জালাল উদ্দীন জানান, দামুড়হুদা উপজেলায় চলতি মৌসুমে ৮৯১ হেক্টর জমিতে ব্রি-৯৮ ধানের আবাদ হয়েছে। এই ধানের জীবনকাল ১১০ দিন থেকে ১১২ ধান। আমাদের জেলায় স্থানীয় খাটো বাবু ও ৪৮ জাতের ধানের আবাদ বেশি হয়। এই বছরই প্রথম ব্রি-৯৮ ধানের আবাদ হয়েছে। বিভিন্ন গ্রামে টপ কার্টিং করে দেখা যাচ্ছে যে, এই ধান হেক্টর প্রতি ৬.৭ টন উৎপাদন হচ্ছে যা বিঘা প্রতি গড়ে ২০ থেকে ২২ মন।

একই উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ব্লকের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুন অর রশিদ বলেন, রোপা আউশে ব্রি-৯৮ ধান আমরা আশা করছি স্থানীয় খাটো বাবু ও ব্রি ধান ৪৮ এর বিকল্প হিসেবে আবাদ হবে। এরই মধ্যে কৃষকদের মধ্যে ভালো আগ্রহ বেড়েছে। যে কৃষকই এই ধান দেখছেন তিনিই আগামীতে এই ধান আবাদ করার আগ্রহ প্রকাশ করছেন। আমরা তাদেরকে বলছি নিজের জমি থেকে এই ধানের বীজ সংগ্রহ করা যায় । যারা আশে পাশে আবাদ করছেন তাদের নিকট থেকেও বীজ সংগ্রহ করার জন্য। যেহেতু এটি চিকন ধান । চিকন ধানের ভাত সবাই পছন্দ করে। সেই হিসেবে ২৮ ধানের বিকল্প হিসেবে ব্রি-৯৮ ধানের আবাদ করতে পারেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জানান, ব্রি-৯৮ জাতের ধান উদ্বাবনকরার পর স্থানীয় কৃষকদের উৎসাহ দেয়া হয়। চলতি মৌসুমেই উপজেলায় প্রথম আবাদ শুরু হয়েছে। কৃষকরা ৮৯১ হেক্টর জমিতে ব্রি-৯৮ জাকের ধান আবাদ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। এই ধানে ওসেচ ও সার কম লাগে। এই জাতের ধানে পোকামাকড়ের আক্রমনও কম। ধানের আকার চিকন ও লম্বা। হেক্টর প্রতি গড়ে ৬.৭ টন উৎপাদন হচ্ছে যা বিঘাতে ২৩/২৩ মন। উৎপাদনে সময় কম লাগায় ও ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা এই জাতের ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলায় আউশ ধানের আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। চলতি মৌসুমে জেলায় রেকর্ড আউশের আবাদ হয়েছে। এ মৌসুমে আউশ ধানের আবাদ হয়েছে ৪৩ হাজার ১৭ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৬হাজার৫৫০ হেক্টর, আলমডাঙ্গায় ৮ হাজার ৭৬৭ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ১০ হাজার ৬০ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ ধানের আবাদ হয়েছে। তিনি বলেন, গত মৌসুমের তুলনায় ৪ হাজার ৩১৮ হেক্টর বেশি জমিতে আউশ ধানের আবাদ হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কৃষিতে আউশ মৌসুমে ব্রি-৯৮ জাত উদ্বাবন একটি মেগা ভ্যারাইটি। এ জাতের ফলন মোটামোটি ভালো। বিঘাতে ফলন ২২ থেকে ২৩ মণ মণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই জাতের ধান চিকন ও চাল লম্বা। ভাতও ঝরঝরে হয়। জীবনকাল বেশি নয়। জীবনকাল ১১০ থেকে ১১২ দিনের মত। গত বছর ১০ হেক্টর জমিতে এই ধানের আবাদ হয়েছিলো ।এ বছর ১ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এ জেলায় স্থানীয় খাটো বাবু ও ব্রি-৪৮ জাতের ধানের আবাদ বেশি হয়। ব্রি-৪৮এর চেয়ে ফলনও দাম বেশি হওয়ায় জেলায় ব্র্রি-৯৮ জাতের ধানের আবাদ জনপ্রিয় হচ্ছে ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেটি আমাদের জন্য খুবই আশা ব্যাঞ্জক। আমি ৪ উপজেলায় সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বলে দিয়েছি বীজ সংগ্রহ করার জন্য। তিনি বলেন,ব্রি-৯৮ খাদ্য নিরাপত্তায় আরো ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখি।

চলতি মৌসুমে জেলায় ব্রি-৯৮ ধান ১ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে গড়ে যদি ৫.৫ ধান উৎপন্ন হয় । ঔই ধান যদি আমরা ১ হাজার ১০০ টাকা মন দরে বিক্রি করি । তাহলে চুয়াডাঙ্গা জেলার কৃষকরা এই মৌসুমে শুধু ব্রি-৯৮ জাতের ধান ২০ কোটি ৮৬ লাখ ৯২ হাজার টাকায় ধান বিক্রি করতে পারবেন।

স্বাআলো/এসএস

.

Author
মফিজুর রহমান জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা
জেলা প্রতিনিধি