বেফাঁস মন্তব্য করে বা সরকারি দলের জন্য ভোট চেয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন মাঠ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে কথা-কাজে আরো সতর্ক হচ্ছেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি সরকারের পক্ষে ভোট চেয়ে সমালোচিত হন জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইমরান আহমেদ। এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরপর তাকে ডিসির পদ থেকে সরিয়ে দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মাঠ প্রশাসনে কোনো কর্মকর্তাকে ডিসি হিসেবে নিয়োগ করলে সাধারণত দুই বছর দায়িত্বে রাখা হয়। তবে সমালোচিত বা গুরুতর অভিযোগ উঠলে যে কোনো সময় মন্ত্রণালয় তাকে সরিয়ে দেয়।
ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুধু বলেন, এরই মধ্যে ডিসির বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘কর্মকর্তাদের বেফাঁস মন্তব্যের কারণে সরকার এবং মন্ত্রণালয় কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে। কারণ অনেক রকম প্রশিক্ষণ দিয়েই মাঠ প্রশাসনে পাঠানো হয় কর্মকর্তাদের। অনেকেই কিছু ক্ষেত্রে ‘স্লিপ অব টাং’ হয়ে যান। বিষয়টি বিব্রতকর। কর্মকর্তাদের কথাবার্তায় সংযত হওয়া প্রয়োজন।’
প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, আমাদের মাঠ প্রশাসনে যেখানেই কর্মকর্তারা ব্যত্যয় ঘটাচ্ছেন সেখানেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বলবো, আপনারা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে, কথাবার্তায় সংযত হবেন, পেশাদারিত্বের পরিচয় দেবেন। আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে সবসময় বলাই আছে এসব বিষয়ে।
এদিকে, জামালপুরের ডিসিকে সরানোর পর বাকি জেলার ডিসিরা নিজেদের কাজ ও কোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্যের ক্ষেত্রে আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
ঢাকা বিভাগের এক ডিসি বলেন, আমাদের কর্মক্ষেত্রের শুরু থেকে মাঠ প্রশাসন নিয়ে নানা প্রশিক্ষণ থাকলেও অনেক সময় ভুল হতেই পারে। তবে চেষ্টা করছি আরও সতর্ক থাকার। দায়িত্বে শুরুতেই এভাবে সরিয়ে দিলে ক্যারিয়ারেও দাগ লেগে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে সিনিয়রদের পরামর্শ নিয়ে থাকি, একজন সচিব স্যার পরামর্শ দেন প্রায়ই নানা বিষয়ে।
চট্টগ্রাম বিভাগের একাধিক ডিসি বলেন, বিষয়টি অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। নির্বাচনের আগে এমন ঘটনায় আমরাও মর্মাহত। একটি ঘটনায় ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে আমরাও শিক্ষা নিচ্ছি।
রংপুরের এক ডিসি বলেন, আগের স্যার যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের পরামর্শ অনেক ক্ষেত্রে কাজে লাগে। আর যেহেতু জেলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ পদ, সেভাবে সতর্ক থাকতে হয়।
সরকারি চাকরি করে প্রকাশ্যে কারও জন্য বা কোনো দলের পক্ষে ভোট চাওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না সাবেক আমলারাও। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, চাকরিবিধি লঙ্ঘন করলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং নিচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আরেক সাবেক সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা বলেন, ভোট চাওয়া দলকে সমর্থন এসব সরকারি চাকরিবিধির আচরণবিধির পরিপন্থী। এসব বিষয়ে নিষেধ আছে। কর্মকর্তাদের বদলিও হচ্ছে, এটা এক ধরনের শাস্তি। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে বদলি করা হয়।’
নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আরো সতর্ক হতে হবে সবকিছুতেই উল্লেখ করে মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা বলেন, এসব ঘটনায় অন্যরা সাবধান হবেন বলে আমি মনে করি। মাঠ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকলেই হবে না, মানুষকে বুঝতে দিতে হবে তারা নিরপেক্ষ, মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে।
সম্প্রতি আরো কয়েকটি ভোট চাওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। অনেকেই নিয়ম লঙ্ঘন করে অংশ নিয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। গত মাসে কুমিল্লার লাঙ্গলকোট ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে পুলিশের দুই কর্মকর্তা (ওসি) প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট চেয়ে সমালোচিত হয়েছেন। পরে তাদেরকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে অন্যত্র বদলি করা হয়।
এর আগে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব চাকরিতে থেকেই নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন। চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার কারণে গত ১১ জুলাই সচিবের দায়িত্ব থেকেই অব্যাহতি দিয়ে ওই সিনিয়র সচিবকে? বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫ (১) ধারায় (রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ) বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে বা কোনো ধরনের সহায়তা করতে পারবেন না।
২৫(৩) ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অথবা অন্যত্র কোনো আইন সভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অথবা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে বা অন্য কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করতে বা প্রভাব খাটাতে পারবেন না। শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রচারণায়ও যেন মন্ত্রী-এমপিরা অংশ নিতে না পারেন, সে জন্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সতর্ক করা হয়।
স্বাআলো/এসএ
.
