বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতির আগে পাহাড়ে ২৬ হত্যাকাণ্ড

জেলা প্রতিনিধি বান্দরবান: জেলার রুমায় ব্যাংক ডাকাতির আগে পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে ২৬ জনকে হত্যা করেছেন। তাঁদের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চার সদস্য রয়েছেন। অপহরণ করেছেন ১৫ জনকে। ভুক্তভোগীদের পারিবারিক সূত্রে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, পাহাড়ে কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেমে নেই। এখনো তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী পাহাড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে। গুলি ছুড়ে পাহাড়ি জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তারা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টা করছে।

তারা বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অপপ্রচার চালাচ্ছে।

যেভাবে কেএনএফের হত্যাকাণ্ড শুরু

ছোট একটি গ্রাম সাইজামপাড়ায় ২০২২ সালের জুন মাসে হামলার মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠে কেএনএফ। সাইজামপাড়ার অবস্থান বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নে। তবে রুমা উপজেলার রনিনপাড়া থেকে যাতায়াত কিছুটা সহজ।

বাংলাদেশ-ভারত-মিজোরাম ত্রিদেশীয় সীমান্তলাগোয়া ধুপানিছড়া। গভীর জঙ্গলাকীর্ণ খাড়া পাহাড় হওয়ায় এখানে নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যাতায়াত করা কঠিন। সে কারণে বাংলাদেশি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো ছাড়াও ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমারের চিন প্রদেশের বেশ কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। এর ফলে এই এলাকাটিতে জনবসতি গড়ে উঠছে না।

সাইজামপাড়া নামে একটি পাড়া হলেও মাত্র তিনটি ত্রিপুরা পরিবার এই গ্রামে বসবাস করে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মূল গ্রুপ এখানে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য বিস্তার করে আছে। জুম্ম ল্যান্ড আর্মি (জেএলএ) নামে তারা এখানে পরিচিত।

এই এলাকা থেকে জেএসএস সমর্থিত বাহিনীকে সরিয়ে দেওয়ার বিশেষ কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নেয় নবগঠিত কেএনএফ। পাড়াবাসীকে তারা হুমকি দেয়, যাতে জেএসএসের অস্ত্রধারীরা এই গ্রামে কোনোভাবেই আশ্রয় না পায়। তবে পাড়াবাসী কোনোভাবেই জেএসএসকে তাড়ানোর সাহস পায় না। এ কারণে কেএনএফের সামরিক শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সদস্যরা ২০২২ সালের ২১ জুন হামলা চালান সাইজামপাড়ায়।

তাঁরা ব্যাপক গুলি ছুড়ে চিতারাম ত্রিপুরা (৬৫) এবং তাঁর দুই ছেলে বিশ্ব চন্দ্র ত্রিপুরা ও সুভাস ত্রিপুরাকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় দুইটি শিশুসহ আরো পাঁচজন আহত হয়। কিন্তু দুর্গম এলাকা হওয়ায় সেখানে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধারে আরো দুই দিন লেগে যায়। এই ঘটনার পর কেএনএ সদস্যরা সাইজামপাড়ার আশপাশের আরো ছয়টি ত্রিপুরা গ্রাম এবং পাঁচটি তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামের বাসিন্দাদের পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিতে থাকেন।

ছয়টি ত্রিপুরা গ্রামের ৯২ পরিবার এবং পাঁচটি তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামের ৬২ পরিবার তাদের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এদিকে এমন হামলার ঘটনায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী প্রতিবাদমুখর হয়ে দাঁড়ায়। তারা সরকারের কাছে স্মারকলিপিও দেয়। এতে টনক নড়ে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর। অন্যদিকে জেএসএস এই ঘটনাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। দীর্ঘদিনের একটি সংগঠনকে নবগঠিত একটি ছোট সংগঠন কেএনএফের হুমকিকে তারা মর্যাদাহানিকর বলে মনে করে এবং কেএনএফ দমনে ছোট ছোট কয়েকটি ঘটনা ঘটায়।

সাইজামপাড়ায় হামলার পর বান্দরবানের রোয়াংছড়ির কয়েকটি পয়েন্টে জেএসএসের সংঘর্ষ হয়। এতে মাঝেমধ্যে উভয় পক্ষের দু-একজন করে হতাহত হলেও সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সঙ্গে। গত বছরের ৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি এবং রুমা উপজেলার মধ্যবর্তী খামতাংপাড়ায় সংঘটিত এই ঘটনায় ইউপিডিএফের হাতে প্রাণ হারায় আটজন। তাদের মধ্যে সাতজনকে কেএনএফের সদস্য বলে শনাক্ত করে স্থানীয় লোকজন।

এভাবেই আঞ্চলিক বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ এবং ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে নবগঠিত এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ।

এর মধ্যে কেএনএফের সঙ্গে একটি মৌলবাদী সংগঠনের সম্পর্কের তথ্য পায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি র‌্যাবের এক বিশেষ অভিযানে কেএনএফের প্রধান ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রামজুং পাহাড় থেকে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ১৭ জন এবং কেএনএফের তিনজনকে আটক করে। তাদের মধ্যে লাল মুন সিয়াম বম, ফ্লাগসুং বম বান্দরবানের বাসিন্দা অন্যদিকে মাল সম পাংকোর বাড়ি রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায়। এরপর র‌্যাবের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযানে প্রায় তছনছ হয়ে যায় কেএনএফের দুর্গম এলাকার যোগাযোগ নেটওয়ার্ক।

কিছুদিন থেমে থাকার পর গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে কেএনএফ আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় তাদের সঙ্গে শান্তি সংলাপ শুরু হয়। সরকারের পরামর্শে স্থানীয় উদ্যোগে গঠিত হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। এই কমিটির সঙ্গে চারটি ভার্চুয়াল বৈঠক এবং দুইটি সরাসরি সংলাপের পর তৃতীয় সরাসরি সংলাপের মাত্র ২০ দিন আগে গত ২ এপ্রিল রাতে কেএনএফ ও কেএনএ রুমা উপজেলা সদরে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ব্যাংকের ভল্ট না ভাঙতে পারলেও তারা সেখান থেকে পুলিশের দুইটি এসএমজি এবং আটটি চায়নিজ রাইফেল লুট করে। তারা ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

ব্যাংকে হামলার আগে তারা উপজেলা কমপ্লেক্সে অবস্থিত আনসার ক্যাম্প থেকে চারটি শটগান ছিনিয়ে নেয় এবং মসজিদে ঢুকে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায়। পরদিন ৩ এপ্রিল দিনদুপুরে কেএনএর সদস্যরা থানচি উপজেলা সদরের সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক শাখায় হামলা চালায়। সেখানের ক্যাশ কাউন্টার থেকে কয়েক লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায় তারা।

এ ঘটনার পর পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসারের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী কেএনএফবিরোধী অভিযান শুরু করে। গত ৮ এপ্রিল থেকে এই অভিযানে নেতৃত্ব দেয় সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথ অভিযানে রুমার বেথেলপাড়া থেকে ১৮ নারীসহ গ্রেপ্তার করা হয় ৪৯ জনকে। এ ছাড়া অন্যান্য এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে যৌথ বাহিনী আরো ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। সব মিলিয়ে যৌথ বাহিনীর অভিযানে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ৬৬ জন। তাদের মধ্যে ৫৩ জনকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদকারী এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারা এরই মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। সেসব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।

স্বাআলো/এস

Share post:

সাবস্ক্রাইব

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

সর্বাধিক পঠিত

আপনার জন্য প্রস্তাবিত
Related

প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোটগ্রহণ কাল

ঢাকা অফিস: ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৩৯...

যৌথবাহিনীর অভিযানে কেএনএফের সন্ত্রাসী নিহত

বান্দরবানে সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ)...

শিক্ষক নিয়োগের আরেকটি গণবিজ্ঞপ্তি আসছে

ঢাকা অফিস: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৯৬ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগের...

দ্বিতীয় দফায় বাড়লো হজ ভিসা আবেদনের সময়

ঢাকা অফিস: হজ ভিসার জন্য আবেদন করার সময় দ্বিতীয়...