খুলনা ব্যুরো: খুলনা মহানগরীতে চার শতাধিক হোটেল-রেস্টুরেন্ট থাকলেও এর ৯৫ শতাংশ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া নগরীর বড় বাজার এলাকায় ২০টি মার্কেট অগ্নিঝুঁকির তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ৫৭ প্রতিষ্ঠান অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ত্রুটি থাকায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে আগুন নেভানো সম্ভব হবে না। আগুন থেকে নিরাপদ রাখতে ফায়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৯ দফা পরামর্শ দিয়েছে।
অপরদিকে, নগরীর ১১টি আবাসিক এলাকার ৬৬টি ভবনের নকশায় ত্রুটি রয়েছে। আবাসিকের অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী ভবনও রয়েছে।
এই ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না রেখেই হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কম্পিউটার ব্যবসা, ওষুধের ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের শোরুমের ব্যবসা চলছে।
ফায়ার সার্ভিসের সূত্র বলেছে, সরকারি জুটমিলের মধ্যে প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট, স্টার জুটমিল কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেয়া হয়েছে। তারা ২০২১-২২ সাল থেকে ফায়ারের লাইসেন্স নবায়ন করে না। তাদের ফায়ার সেফটি প্লান করতে বলা হয়েছে। ২০১৯ সালে পরিদর্শন করার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নার্গিস মেমোরিয়াল হাসপাতাল, রাশিদা মেমোরিয়াল, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, হোটেল রয়্যাল, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জোহরা মেমোরিয়াল, বয়রা ক্লিনিক, কিওর হোম, প্রাইম ক্লিনিক, আ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ, সিটি মেডিকেল কলেজ, গরীব নেওয়াজ, বাংলাদেশ আই হসপিটাল, ল্যাবএইড, শিশু হাসপাতাল, খালিশপুর ক্লিনিক উল্লেখযোগ্য।
এ সংস্থার অপর একটি সূত্র বলেছেন, তারা বিভিন্ন এলাকায় জরিপ করে দেখেছেন, ক্লে-রোড অপ্রস্থ হওয়ায় বড় বাজারও অগ্নিঝুঁকিতে। এ ছাড়া সোনাডাঙ্গার ডেল্টা লাইফ টাওয়ার, সিটি ট্রেড, মাতৃভাষা টাওয়ার, হোটেল সিটি-ইন, ডাকবাংলা এলাকার শেখ মজনুর ভবনও অগ্নিঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
সূত্র জানায়, খুলনা মহানগরীতে ছোট-বড় চার শতাধিক হোটেল রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এছাড়াও নগরীর উপকণ্ঠ জিরোপয়েন্ট, খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর ও ফুলতলা উপজেলায় খুলনা-যশোর মহাসড়কের পাশেও অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। এ সব হোটেল-রেস্টুরেন্টের রান্নার কাজে মাটির চুলাসহ ছোট-বড় গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়। এসব চুলার আগুন ও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
অপরদিকে, ভবন মালিকরা নকশা ও সেফটি প্ল্যানের অনুমোদন নিলেও ভবন ব্যবহারের অনুমোদন (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) নেন না। ফলে নগরীর হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৯৫ ভাগের পর্যাপ্ত ফায়ার সেফটি না থাকলেও কর্তৃপক্ষ যথোপযোগী ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এছাড়া যেসব ভবনে ৫০ জনের বেশি মানুষ বসবাস করেন সেই ভবনগুলোয় দুটি সিঁড়ি থাকার কথা থাকলেও এটা মানা হচ্ছে না।
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) হিসাব অনুযায়ী, নগরীর ১১টি আবাসিক এলাকায় প্রায় চার হাজার প্লট রয়েছে। এর মধ্যে ৬৬টি ভবনের নকশায় ত্রুটি রয়েছে। এছাড়া আবাসিকের অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী ভবনও রয়েছে। এই ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না রেখেই হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কম্পিউটার ব্যবসা, ওষুধের ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের শোরুমের ব্যবসা চলছে। এছাড়া নগরীর বড় বাজার এলাকায় ২০টি মার্কেটকে অগ্নিঝুঁকির তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে খাজা খান জাহান আলি হকার্স মার্কেট, শহিদ সোহরাওয়ার্দী মার্কেট, জব্বার মার্কেট, মশিউর রহমান মার্কেট, হেরাজ মার্কেট এবং মশলাপট্টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ১১টি মার্কেট মাঝারি ধরনের এবং তিনটি নিচু ধরনের অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এসব মার্কেটে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করার সুযোগ নেই।
খুলনা মহানগর হোটেল-রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির সভাপতি ও রাজমহল রেস্টুরেন্টের মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, সব হোটেল-রেস্টুরেন্টে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা আছে কিনা সেটা বলতে পারবো না। তবে ভালো রেস্টুরেন্টগুলোতে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা আছে।
তিনি বলেন, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার বেইলি রোডের রেস্টুরেন্টে আগুন লেগে হতাহতের পর আমাদের সদস্যরা তাদের রেস্টুরেন্টগুলোতে অগ্নিনির্বাপকের সুব্যবস্থা নিয়েছে।’
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, হোটেল-রেস্টুরেন্টে সিলিন্ডারের গ্যাসে রান্নার কাজ করা হয়। সিলিন্ডার লিকেজসহ বিভিন্ন কারণে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ঢাকার মতো খুলনায় যাতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা না ঘটে, সেই জন্য ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বৃদ্ধি করা জরুরি। এছাড়া যে সব হোটেল-রেস্টুরেন্টের অগ্নিনির্বাপণের সুব্যবস্থা নেই, জনস্বার্থে দ্রুত সেগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিত।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের সাবেক উপ-পরিচালক কামাল উদ্দিন ভূইয়া বলেছেন, অগ্নিঝুঁকি এড়াতে এসব প্রতিষ্ঠানকে ৯ দফা পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বিকল্প সিঁড়ি নেই, জরুরি লাইট নেই, প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগ নেই, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী নেই।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনার সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, ফায়ার সার্ভিস ও কেসিসি’র সমন্বয়ে ৪৮টি ভবন ও ২০টি মার্কেটকে অগ্নিঝুঁকির তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে বড় অংশ সরকারি ভবন, প্রতিষ্ঠান। যাদের বেশিরভাগের সেফটি ব্যবস্থা নেই। সংশ্লিষ্টদের একাধিকবার সতর্ক করে নোটিশ করা হয়েছে। কিন্তু শুনছে না। ফলে আগামী এক মাসের মধ্যে তাদের চূড়ান্ত নোটিশ করা হবে। এরপরও কোনো কাজ না হলে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ জন্য কেসিসি, কেডিএ এবং জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও চিঠি দেয়া হবে।
স্বাআলো/এস