টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব দাবি করা পোস্ট সরালো ভারত

ঢাকা আফিস: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে দাবি করে ভারত। এ নিয়ে দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে বৃহস্পতিবার একটি পোস্টও দেয়া হয়।

ওই ফেসবুক পোস্টের নিচে প্রতিবাদ জানান হাজারো বাংলাদেশি। সবারই একটিই প্রশ্ন ছিলো, টাঙ্গাইল শাড়ি কীভাবে ভারতের হয়? ভারত কীভাবে এ দাবি করে? বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনসহ সরকারের নেতৃত্বস্থানীয়রাও। শেষ পর্যন্ত বিতর্কের জেরে পোস্টটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রবিবার থেকে এ-সংক্রান্ত পোস্টটি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেইজে আর দেখা যাচ্ছে না।

ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওই পোস্টে দাবি করা হয়েছিলো টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত। এটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রঙ এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। টাঙ্গাইলের প্রতিটি শাড়ি ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে দক্ষ কারুকার্যের নিদর্শন।

এর প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ শুভেচ্ছাদূত ও ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট ধারণার প্রবক্তা বিবি রাসেল বলেন, এটি এক উদ্ভট ও ভিত্তিহীন দাবি। টাঙ্গাইল শাড়ি একেবারে বর্তমান বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ।

টাঙ্গাইল শাড়ি নিজেদের বলে দাবি ভারতের বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্র শেখর সাহা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্বের দাবি কোনোভাবেই ভারত করতে পারে না। কারণ ভৌগোলিকভাবে টাঙ্গাইল কোনোকালেই পশ্চিমবঙ্গের ছিলো না। তারা অন্য নামে তাদের শাড়ির জিআই স্বীকৃতি দিতে পারে কিন্তু সেটির সঙ্গে টাঙ্গাইল নাম থাকলে কোনোভাবে যৌক্তিক হবে না।

পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুর রহমান বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি নিয়ে ভারত যা করেছে তা মেনে নেয়ার সুযোগ নেই।

টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিয়ে রবিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ভারতে পেটেন্ট রাইট করেছে। তারা এটি কীভাবে করেছে, তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমাদের জানা নেই। তবে আমরা এটি নিয়ে জরুরিভাবে মন্ত্রণালয়ে বসেছি বৈঠক করেছি। টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের থাকার জন্য যা যা ব্যবস্থা নেয়ার আমরা খুব দ্রুত সে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

জাতীয় অধ্যাপক আব্দুল মালিকের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক

প্রসঙ্গত চলতি বছরের (২ জানুয়ারি) টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এতে টাঙ্গাইল শাড়িকে ধরা হয় নদীয়া ও পূর্ববর্ধমানের পণ্য হিসেবে।

কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা এবং এই শিল্পের আদি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্তদের বয়ানে এই শাড়ির উৎপত্তিস্থল হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে উঠে আসছে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার পাথরাইল, নলশোধা, ঘারিন্দাসহ বাইশ-তেইশটি গ্রামের নাম। সেখানকার তাঁতীদের বংশধরের একজন হরিপদ বসাক। জন্ম ও বেড়ে ওঠা পূর্ব বাংলায় হলেও বর্তমানে বসবাস করছেন পশ্চিম বঙ্গের নদীয়ায়।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের ওইসব গ্রামকে একসঙ্গে বাইশগ্রাম বলে চিহ্নিত করা হতো। এসব গ্রামই ঠিকানা ছিলো তাঁতীদের। যাদের পদবি ছিলো বসাক।

হরিপদ বসাক জানান, ১৮৫০ সাল বা তার কাছাকাছি সময়ে তৎকালীন ধামরাই এবং চৌহট্ট নামে দুটি গ্রামে মসলিনের উত্তরসূরী কিছু তাঁতি বসবাস করতেন। সন্তোষ, করটিয়া ও দেলদুয়ারে জমিদারি পত্তনের সময় অন্যান্য পেশাজীবীদের পাশাপাশি ওই তাঁতিদেরও সেসব জায়গায় নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়। এসব গ্রামের মানুষেরা যে শাড়ি বয়ন করতেন তাই টাঙ্গাইল শাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।

২০১৪ সালে টাঙ্গাইল জেলার তাঁতীদের নিয়ে একটি গবেষণা করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক সুব্রত ব্যানার্জি, মনিরুজ্জামান মুজিব ও সুমনা শারমিন।

গবেষণায় দেখা যায়, পাকিস্তান পর্বে তো বটেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও বসাক সম্প্রদায়ের পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। স্বাধীনতার পর পুরো টাঙ্গাইলের নলশোধা গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে তাঁত থাকলেও ২০১৪ সালে সরেজমিনে তারা দেখতে পান মাত্র ২২টি পরিবার এই পেশায় যুক্ত আছে।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁতশিল্প গবেষক নিলয় কুমার বসাক বলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বসাক সম্প্রদায়ের বড় অংশই ভারতে চলে যান। তাদের ভিড়টা বেশি হয় নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রাম এবং পূর্ব বর্ধমানের ধাত্রী গ্রাম ও সমুদ্রগড়ে। তাদের বদৌলতে নদীয়া ও পূর্ব-বর্ধমানে টাঙ্গাইল শাড়ি পরিচিতি লাভ করে।

তিনি আরো বলেন, দেশভাগের বলি হয়ে ভারতে চলে এলেও টাঙ্গাইল শব্দটি ছিল বসাক তাঁতিদের অস্থিমজ্জাগত। ফলে উদ্বাস্তু এই তাঁতিরা নিজেদের বয়নীকৃত শাড়ির নাম বা বয়ন কৌশল পরিবর্তন করার কথা কল্পনাও করেননি।

স্বআলো/এস

Share post:

সাবস্ক্রাইব

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

সর্বাধিক পঠিত

আপনার জন্য প্রস্তাবিত
Related

‘জাল ভোট পড়লেই কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে’

নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেছেন, কোনো কেন্দ্রে একটি...

সোনার দাম আবারো বেড়েছে

ঢাকা অফিস: দেশের বাজারে আবারো সোনার দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ...

করোনায় আক্রান্ত একজনের মৃত্যু

ঢাকা অফিস: বেশকিছু দিন পর বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে...

ডিবিতে মামুনুল হক

ঢাকা অফিস: হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা...