তিস্তার বাঁধ ভাঙলো: ৫ জেলায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা, সতর্কতায় মাইকিং

ভারতের উত্তর সিকিমে অতিভারী বর্ষণে তিস্তা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। সেখানকার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ড্যাম (বাঁধ) ভেঙে গিয়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জলপাইগুড়িতে জারি করা হয়েছে সতর্কতা। এতে বাংলাদেশে হু হু করে প্রবেশ করছে পানি। ফলে বাংলাদেশের উত্তরের রংপুর অঞ্চলের তিস্তাপাড়ে বড় আকারের বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই তিস্তা নদীবেষ্টিত রংপুরের পাঁচ জেলায় ভয়াবহ বন্যার সতর্কতা জারি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা।

অসময়ে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কায় নদী পাড়ের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অনেকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে শুরু করেছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে সেনাবাহিনীর সহায়তা চেয়ে রংপুরের জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানিয়েছেন গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

এছাড়াও রংপুরের কাউনিয়া ও পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, লালমনিরহাটের আদিতমারি, সদর, কালীগঞ্জ, হাতিবান্ধা ও নীলফামারী ডিমলা, জলঢাকা উপজেলাসহ বিভিন্ন উপজেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত দেশের উজানে ভারতের গজলডোবা পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ২৮৫ সেন্টিমিটার এবং দোমুহুনী পয়েন্টে বুধবার সকাল থেকে ৮২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে বাড়ছে অন্য নদীর পানিও।

পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে বিকেল ৩টায় বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করে ৫২ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার, কাউনিয়া পয়েন্টে ২৮ দশমিক ২৮ সেন্টিমিটারে প্রবাহিত হচ্ছিলো। এ ছাড়া দুপুর ১২টায় ব্রহ্মপুত্র নদী চিলমারী পয়েন্টে ২ দশমিক ৩৪ মিটার, ধরলা নদী কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ১ দশমিক ৮২ মিটার এবং দুধকুমার নদী পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ দশমিক ৩২ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে মধ্যরাত পর্যন্ত এবং কাউনিয়া পয়েন্টে বৃহস্পতিবার ভোর রাতে বিপৎসীমা অতিক্রম করার পূর্বাভাস রয়েছে। এতে করে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

ভয়াবহ বন্যার খবরে প্রস্তুতি নিয়েছে রংপুরের স্থানীয় প্রশাসন। তিস্তার বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে স্থানীয়দের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং শুরু হয়েছে। বন্যাকালীন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো।

এব্যাপারে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানিয়েছেন, ভারতের সিকিমে ড্যাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ড্যামে প্রচুর পানি থাকে। ওই পানি প্রবেশ করলে রংপুর অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা হতে পারে। তিনি আরও জানান, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারতের সিকিম অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। এতে করে তিস্তা নদীতে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবে। বিপৎসীমা অতিক্রমের সর্বোচ্চ রেকর্ড ৫২ দশমিক ৮৪ মিটারে কাছাকাছি ডালিয়া পয়েন্টে পানি তিস্তা নদীর পানি পৌঁছাতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব তথ্য প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অবহিত করেছে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান জানান, ২৪ ঘণ্টায় রংপুরে ২৭.৪, দিনাজপুরে ৫৪.৪, সৈয়দপুরে ২৭, নীলফামারীর (ডিমলা) ১১.৯, কুড়িগ্রামে ১৫ এবং পঞ্চগড়ে ৭.৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

আরেক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী শনিবার (৭ অক্টোবর) নাগাদ দেশের উত্তরাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে দেশের রংপুর উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, আপার করতোয়া, আপার আত্রাই, পুনর্ভবা, কুলিখ টাঙ্গন, ইছামতি যমুনা ও যমুনেশ্বরী নদীর পানি সমতল সময় বিশেষে দ্রæত বাড়তে পারে। এই সময়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মহানন্দা, ছোট যমুনা, করতোয়া, আত্রাই ও গুর নদীর পানি সমতল সময় বিশেষে দ্রুত বাড়তে পারে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ তামান্না বলেন, বন্যায় যেনো মানুষের জানমালের রক্ষা হয় সেলক্ষ্যে প্রশাসন কাজ করছে। বন্যা স্থায়ী হলে ক্ষতিগ্রস্থদের খাদ্য সহায়তা প্রদান এবং বন্যায় শেষে ক্ষতিগ্রস্থদের পূর্নবাসনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে।

কাউনিয়ায় সতর্কতা জারিঃ ভারতের উত্তর সিকিমে ভয়াবহ বন্যা ও বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় রংপুরের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এটি রাতের দিকে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, টেপামধুপুর, হারাগাছ, শহীদবাগ ইউনিয়নসহ নদী তীরবর্তী এলাকায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নদী পার্শ্ববর্তী এলাকার সর্বসাধারণকে সতর্কতা অবলম্বনে ইতোমধ্যে মাইকিং শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন। বুধবার বিকেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে সতর্কতা অবলম্বনে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিদুল হক বলেন, সকাল থেকে নদী তীরবর্তী বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিদর্শন করছি। নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষদের সতর্ক করতে মসজিদের মাইকে মাইকিং করা হচ্ছে। এতে সর্বসাধারণকে গরু ও ছাগলসহ প্রয়োজনী জিনিসপত্র নিয়ে সতর্ক থেকে নিকটস্থ বন্যা আশ্রয়ণ কেন্দ্র /প্রাইমারি/হাইস্কুলে অবস্থান নেয়ার জন্য বলা হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিদুল হক আরো বলেন, এখনো পর্যন্ত উপজেলার কোথাও পানি বন্দির খবর পাওয়া যায়নি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং গ্রাম পুলিশদের নদী তীরবর্তী এলাকার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে আমাদের সকল ব্যবস্থা নেওয়া আছে।

ভারতের উত্তর সিকিমে ভয়াবহ বন্যা ও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশ অংশে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।

বুধবার (৪ অক্টোবর) বিকেল ৪টা থেকে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের অনেক বসতবাড়িতে পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা ও ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। এদিকে নদীর দুই পারের মানুষকে সতর্কতা অবলম্বনে মাইকিং করছে স্থানীয় প্রশাসন।

বুধবার বিকেল ৫টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহের উচ্চতা রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ মিটার ২৫ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার (বিপৎসীমা ৫২ মিটার ১৫ সেন্টিমিটার) ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে বিকেল ৪টায় একই পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো।

এদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, তিস্তার উৎসে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে চুংথাং হ্রদে পানি বেড়ে গেছে। হ্রদের পানি আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়ে বাঁধ খুলে দেওয়া হলে ভাটিতে নদীর পানির স্তরের উচ্চতা ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যায়।

ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, ভারতের গজলডোবা পয়েন্টে তিস্তার পানির সমতল গত মধ্যরাতে প্রায় ২৮৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে। দোমুহুনী পয়েন্টে বুধবার সকালে প্রায় ৮২ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং তা অব্যাহত আছে।

পাউবো আরো জানায়, তিস্তা নদীর পানি সমতল ডালিয়া পয়েন্টে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ বিকেল ৪টার দিকে ডালিয়া পয়েন্টের পানি সমতল বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপরে অবস্থান করছে। ডালিয়া পয়েন্টে রাতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর পর্যন্ত উঠতে পারে। এর ফলে লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকাসমূহ প্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এরপর মধ্যরাত পর্যন্ত কিছুটা হ্রাস পেয়ে পরবর্তীতে পুনরায় পানি বৃদ্ধি পেতে পারে।

ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়নুল হক বলেন, একদিকে উজানের ঢল, অন্যদিকে অবিরাম বৃষ্টি হওয়ায় মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। উত্তর খড়িবাড়ী গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হাঁটু থেকে কোমর পানি। নিম্নাঞ্চলের মানুষকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকাল থেকেই সতর্কতা জারি করে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনও করেছি। এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি।

স্বাআলো/এস

Share post:

সাবস্ক্রাইব

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

সর্বাধিক পঠিত

আপনার জন্য প্রস্তাবিত
Related

যারা একবেলা ভাত খেতে পারতো না, তারা এখন চারবেলা খায়: প্রধানমন্ত্রী

ঢাকা অফিস: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গ্রামের অর্থনীতি পাল্টে...

বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সুরক্ষিত: খাদ্যমন্ত্রী

ঢাকা অফিস: খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, শেখ হাসিনা...

র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিষয়ে যা জানাল যুক্তরাষ্ট্র

ঢাকা অফিস: মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল...

৬ তারিখে বাজেট দেব, বাস্তবায়নও করবো : প্রধানমন্ত্রী

ঢাকা অফিস: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা ৬ তারিখে...