spot_img

বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব, ২০ হাজার বাড়িঘর বিধস্ত

আজাদুল হক, বাগেরহাট: সাগর সংলগ্ন পুর্ব- সুন্দরবন ও উপকুলীয় জেলা বাগেরহাটে শরণখালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে তিনদিন ধরে ভারি বৃষ্টিপাত, ঝড়ো বাতাস ও জলোচ্ছাসের তীব্রতা কাটিয়ে মঙ্গলবার (২৮ মে) রোদের দেখা মিলেছে।

তবে জেলা শহরবাদে বিদ্যুৎহীন রয়েছে জেলার অধিকাংশ এলাকার গ্রামীন জনপদ। শহরাঞ্চলে সোমবার রাতের দিকে কিছু এলাকাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলেও অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ বিহীন ছিলো ৪৮ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে। অবিরাম বৃষ্টির পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ে গাছপালা পড়ে সঞ্চালন লাইনের তার ছিড়ে ও বৈদ্যুতিক খুটি উপড়ে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় মুঠোফোনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ সচল রাখতে পারছে না দুর্যোগকবলীত এলাকার বাসিন্দারা। দূর্বল হয়ে পড়েছে মোবাইল নেটওয়ার্কও। মঙ্গলবারও বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দী রয়েছেন হাজারও পরিবার। কিছু এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও ঘর থেকে রান্নার চুলা বেহাল অবস্থায় আছে।

দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে কিছু এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে বলে বলছেন স্থানীয়রা। বাগেরহাট ওজোপাডিকোর নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউল হক জানান, সোমবার বিকেলেই শহর কেন্দ্রিক কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ চালু করা হয়। তবে বার বার লাইন ট্রিপ করার কারণে ঝড়ো বাতাস থাকার কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। ঝড় বৃষ্টির মাঝেও কাজ করে তারা দ্রুত সময়ের মাঝে জেলা শহরে সঞ্চালন স্বাভাবিক করতে পেরেছে। তবে এখনো কিছু গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সার্ভিস তার ছিড়ে যাওয়ায় এবং মিটার ভেঙ্গে যাওয়াতে তাদের লাইন চালু করতে সময় লাগছে। ঝড়ে তাদের প্রায় আটটি বৈদ্যুতিক পোল ক্ষতিগস্থ হয়। আর জেলার সবচেয়ে বেশি গ্রাহককে বিদ্যুৎ সেবা দেওয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ব্যপক ক্ষতির মুখে পড়েছে।

ঝড়ের রাতে দাদি-নাতিকে কুপিয়ে হত্যা

জেলায় পল্লী বিদুৎ সমিতির গ্রাহক প্রায় পাঁচ লাখ। প্রাথমিক হিসেবে তাদের অর্ধশত বৈদ্যুতিক পোল ভেঙ্গে গেছে, হেলে পড়েছে ৮৬টি। তার ছিড়েছে কমপক্ষে সাত শতাধিক স্থানে। ভেঙ্গেছে গেছে ৪০০ মিটার, ৩৫টি ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমান আরো বৃদ্ধি পেতে পারে জানিয়ে বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম সুশান্ত রায় বলেন, বিভিন্ন এলাকায় গাছ পড়ে তাদের পোল ভেঙ্গে ও তার ছিড়ে তাদের সঞ্চালন লাইনের ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ২৩২ জন লাইন ম্যানের সাথে ঠিকাদারের ১০০ জন ও ৭০ জন শ্রমিক নিয়ে কাজ করছেন। দ্রুত সময়ের মাঝে সব এলাকায় সরবরাহ স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলেছে। চার লাখ ৮৫ হাজার গ্রাহকের মাঝে মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ৪০ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সেবার আওতায় আনা গেছে। অপরদিকে, রেমালের প্রভাবে তীব্র ঝড়ো বাতাস, ভারী বৃষ্টিপাত ও উঁচু – জলোচ্ছাসে ব্যপক ক্ষতি হয়েছে কৃষকের। জেলায় কৃষক ও মৎস্য চাষিদের ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা কৃষি বিভাগের ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বাগেরহাট কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শংকর কুমার মজুমদার জানান, মাঠে ধান না থাকলেও পাট, আউশ ধানের বীজতলা, কলা-পেঁপেসহ বিভিন্ন প্রকার ফল, সবজী, পান, আখসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে । প্রাথমিক হিসেবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মাঠে এসব ফসলের ১১ হাজার ৫৮১ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। মঙ্গলবার হয়তো পানি নামতে শুরু করবে। এরপর ক্ষতির প্রকৃতি চিত্র পাওয়া যাবে। সদর
উপজেলার গোটাপাড়া এলাকার মৎস্য চাষি শান্তি চৌধুরী বলেন, ঘেরে মাছ চাষ করি আর পাড়ে সবজি। ঘের তো ভেসে গেছে, পাড়ের সবজিও সব শেষ। ক’দিন আগে মাছ ছাড়লাম। সব শেষ। লবনাক্ততার কারণে এবার ধানের ফলন হয়নি।

ঘূর্ণিঝড়ে ভাঙা গাছ কাটতে গিয়ে বাবা-ছেলের মৃত্যু

এখানে মানুষের প্রধান জীবিকাই মাছ চাষ। অনুরুপমাছের ঘের ভেসে বেশি ক্ষতি হয়েছে রামপাল. মোরেলগঞ্জ, সদর ও মোংলা উপজেলায়। মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়ন ঝড়ে রাতে পুরোটাই চলে যায় পানির নিচে। এখানে বসত ঘর থেকে শুরু করে ঘেরের মাছ সবই ভেসে গেছে।

ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিপন তালুকদার বলেন, এলাকার মনে হয় একটা ঘরও নেই যেখানে পানি ওঠেনি। সব তলিয়ে গেছে। লবনাক্ততার কারণে এখানে ধান হয়না। এই এলাকার মানুষের প্রধান আয়ের উৎস মাছ চাষ। সব ঘের ভেসে গেছে। সবার ঘরে এখন পর্যাপ্ত খাবারও নেই।

ওই এলাকার মৎস্য চাষি শহিদুল নাঈম বলেন, এখানে কয়েকজন মিলে একটা বড় ঘের করতাম। শুরুতে জমির হারির (ভাড়া) টাকা দিতে হইছে আট লাখ টাকা। ক’দিন আগে রেনু (চিংড়ির পোনা) ছাড়ছি ১০ লাখ টাকার। এখন সব ভেসে গেলো। সবার পুজি এক সাথে শেষ হয়ে গেল। বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল মুঠোফোনে বলেন, বাগেরহাটের ৯ উপজেলাতেই মাছের ঘের (বাগদা, গলদা ও সাদা মাছ) রয়েছে।

যার সংখ্যা ৭৪ হাজার। ঘূর্ণিঝড়েরর প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও জোয়ার-জলোচ্ছাসে ৩৫ হাজার মৎস্যঘের তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ক্ষতির পরিমান আরো বাড়তে পারে। এ ঝড়ে জেলার ৭৫টি ইউনিয়নের সবগুলোই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। তাদের প্রাথমিক হিসাবে বিভিন্ন এলাকায় ১০ হাজারের বেশি কাঁচাপাকা বাড়িঘর সম্পূর্ণ এবং ৩৫ হাজার আংশিক ক্ষতিগস্থ হয়েছে। জেলা প্রশাসনের হিসেবে জেলায় দূর্গত মানুষের সংখ্যা পাঁচ লাখ।

অপরদিকে, বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বাগেরহাটের তিন উপজেলার অন্তত পাঁচটি এলাকায় বেড়ীবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলইবুনিয়ার শ্রেনীখালী এলাকায়, পানগুছি নদী তীরবর্তী দৈবজ্ঞহাটি উপ প্রকল্পের দুইটি স্থানে ১০ মিটার ও একই নদীর পঞ্চকরনের দেবরাজ এবং কুমারিয়াজোলা এলাকায় ৪০০ মিটার, শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা খালের রাজৈর এলাকায় ৩৫/১ পোল্ডারের ৮০ মিটার এবং বাগেরহাট সদর উপজেলার ভৈরব নদ তীরবর্তী গোপালকাঠি এলাকার নাজিরপুর উপ-প্রকল্পের ৪০ মিটার ও দড়াটানা নদীর বিষ্ণুপুর এলাকার বেমরতা উপ প্রকল্পে ছয় মিটার বাঁধ জোয়ার ও জলোচ্ছাসের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বাগেরহাট সদর, মোরেলগঞ্জ, মোংলা ও রামপাল উপজেলায় বাঁধের বাইরে থাকা বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জোয়ার-
জলোচ্ছাসের পানিতে প্লাবিত গোটা সুন্দরবনে মিষ্টি পানির পুকুরগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পুরো বনই তলিয়ে যায় পানির নিচে।

এতে বন্যপ্রাণীর ক্ষতির যে শঙ্কা করা হচ্ছিলো তা দেখা যাচ্ছে এখন। বন বিভাগ এখনো পর্যন্ত সাগর সংলগ্ন বনের কটকা ও দুবলা এলাকায় দুইটি মৃত হরিণ উদ্ধার করেছে। লোকালয়ে ভেসে আসার খবর পাওয়া গেছে হরিণ শাবক।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, বনের মাঝে বন বিভাগরে অফিস, কর্মীদের থাকার ঘর, জেটিসহ বেশকিছু অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। সোলার প্যানেল, পানির ট্যাংক উঠিয়ে নিয়ে গেছে। বন্যপ্রাণিরও মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। দুইটা মৃত হরিণ উদ্ধার হয়েছে। তবে বনের মাঝে প্রাণিরা মারা গিয়ে থাকলে সবটা পাওয়াও যাবে না বলে জানান এই বন কর্মকর্তা।

স্বাআলো/এস

Share post:

সাবস্ক্রাইব

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

সর্বাধিক পঠিত

আপনার জন্য
Related

যশোরে তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রীর পাল্টাপাল্টি মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক: যশোরে বাড়ি দখল, মারামারি, টাকা ও স্বর্ণালংকার...

খুলনায় অধিকাংশ স্লুইস গেট নষ্ট, পানিবন্দি বাসিন্দারা

খুলনা ব্যুরো: খুলনা মহানগরীর ৩০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের...

যশোরে বাঁধ ভেঙে তিন গ্রাম প্লাবিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: যশোরের অভয়নগর উপজেলার আতাই নদের বাঁধ ভেঙে...

মাগুরায় নাশকতা মামলায় বিএনপির ১১ নেতা-কর্মী আটক

লিটন ঘোষ জয়, মাগুরা: কোটা আন্দোলনে সহিংসতা এবং নাশকতার...