পবিত্র লাইলাতুল কদর

সম্পাদকীয়: কদরের রাতে মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআন নাজিল করেন। কদরের রাতেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রথম ওহি লাভ করেন এবং রিসালাত অর্জন করেন। এরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আমি ইহা (কোরআন) নাজিল করেছি ক্কদরের রাতে। (সুরাতুল কদর: ১)।

শনিবার (৬ এপ্রিল) ২৬ রমজান দিনগত রাতে সেই লাইলাতুল কদর।

পবিত্র শবে কদর মুসলিম উম্মাহর কাছে অত্যন্ত মহিমান্বিত একটি রাতের নাম। এ রাতে গভীর আবেগে আপ্লুত হয় মুমিনের হৃদয়।

বারোটি মাসের দীর্ঘ বিরতির পরে পাওয়া এ রজনীতে মহান আল্লাহর করুণা লাভের আশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে সকল মুমিন মুসলমানের হৃদয়।

হজরত জিবরাঈল (আ.) নবী ও রাসুলদের কাছে ঐশী বাণী নিয়ে পৃথিবীতে আসতেন।

রাসুলুল্লাহর (সা.) ইন্তেকালের মাধ্যমে নবুয়ত ও রিসালাতের ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হজরত জিবরাঈলের পৃথিবীতে আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বছরে একবার মাত্র কদরের রাতে আল্লাহর নির্দেশে রহমতের একদল ফেরেশতাকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন।

এরশাদ হয়েছে, এ রাতে ফেরেশতারা এবং রূহ (জিবরাইল আ.) প্রত্যেক কাজের জন্য তাঁদের পালনকর্তার নির্দেশসহ অবতীর্ণ হন (সুরাতুল কদর: ৪)। শবে ক্কদরে সমগ্র সৃষ্টির আগামী এক বছরের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। অর্থাৎ লওহে মাহফুজ থেকে তা নকল করে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয়। সুরাতুল কদরের ‘মিন কুল্লি আমরিন’ অংশের তাফসিরে কাতাদাহ প্রমুখ মুফাসসিরগণ বলেন, এ রাতে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং মানুষের হায়াত,মউত,রিজিক,দৌলত ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। (ইবনে কাসির) হজরত ইমাম শা’বী (র.) লিখেছেন, লাইলাতুল কদরে ফেরেশতারা মসজিদবাসী মুমিনদের জন্য শান্তির দোয়া করতে থাকেন। এরশাদ হয়েছে, রাতটি ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত কল্যাণময় (সুরাতুল কদর: ৫)।

লাইলাতুল কদরের ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, লাইলাতুল কদর সম্পর্কে তুমি কি জানো? ক্কদরের রাত এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম(সুরাতুল কদর : ২,৩)। লাইলাতুল কদরের ফজিলত সম্পর্কে এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: এ মাসে এমন একটা রাত আছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয় সে সত্যিকারের কপাল পোড়া। (ইবনে কাসির) অর্থাৎ একটি মাত্র রাত ‘লাইলাতুল কদরের’ ইবাদতের সওয়াব একাধারে তিরাশি বছর ইবাদত করার চেয়েও বেশি।

শবে কদর কোন রাত এ সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ মুহাক্কিকের মত হলো,মাহে রমজানের শেষ দশ দিনের যে কোনো বেজোড় রাতে শবে কদর হতে পারে। আর এ মতটাই দালিলিকভাবে বিশুদ্ধ বলে মনে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজান মাসের শেষ দশ দিনে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো ।

কদরের রাতটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিন বান্দার জন্য বিশেষ এক উপহার। তাই ইবাদত- বন্দেগির মাধ্যমে সে সুযোটাকে কাজে লাগানোই মুমিনের কাজ। যে কোনো ইবাদতের মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা যেতে পারে।

হজরত আয়েশা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি একবার রাসুলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শবে ক্কদর কোন রাত সেটা যদি আমি বুঝতে পারি তাহলে আমি তাতে কি দোয়া করবো? তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, তুমি বলবে, হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো, অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।

পরহেজগার মুসলমানরা আজ রাত ব্যাপী আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ ও পাপ মোচনের জন্য ইবাদত বন্দেগীতে কাটাবেন। সকলের ইবাদত মহান আল্লাহ কবুল করুন । নির্ধারিত দিনের জন্য ঈদ মোবারক ঈদ হলো মুসলমানদের জন্য শরিয়ত সম্মত দুইটি আনন্দ উৎসবের দিন। একটি হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর, আরেকটি হচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় একটি বৃহত্তম উৎসব। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে রোজাদারদের জন্য বিশেষ পুরস্কারও।

ঈদের তাৎপর্য অপরিসীম। ঈদের নামাজের শেষে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে বলতে থাকেন, হে আমার প্রিয় বান্দারা আমি আজকের এ দিনে তোমাদের সকল পাপ গুলোকে পুণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দিলাম। অতএব তোমরা নিষ্পাপ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাও। (বায়হাকি ও মিশকাত )

মহানবী (সা) ইরশাদ করেন, ঈদের আনন্দ শুধু তাদের জন্য যারা রমজানের রোজা, তারাবিসহ যাবতীয় আল্লাহর বিধি-বিধান গুরুত্ব সহকারে আদায় করেছে। আর যাহারা রমজানের রোযা ও তারাবিহ আদায় করেনি তাদের জন্য ঈদের আনন্দ নেই, বরং তাদের জন্য ঈদ তথা আনন্দ অগ্নিশিখা সমতুল্য। (বুখারি) মহানবী (সা.) হাদিসের মধ্যে আরো ইরশাদ করেন যে, যারা রমজানে রোযা রাখেনি তারা ঈদের নামাজে সুসংবাদ প্রাপ্ত মানুষের কাতারে শামিল হবে না। তাদের জন্য কোনো আনন্দ নেই। আর যারা রোজা পালন করেছে, গরিবদেরকে নিজের মাল থেকে ফিতরা দিয়েছে শুধুমাত্র ঈদ তাদের জন্যই। তবে যাদের রোযা রাখার বয়স হয়নি অথবা বিশেষ কোনো কারণে রোজা রাখতে পারেনি তারাও ঈদের এই আনন্দে শরীক হতে পারবে। কিন্তু যারা বিনা কারণে এবং অলসতা করে রোজা রাখেনি তাদের জন্য এ ঈদে আনন্দ নেই। এ ঈদ তাদের জন্য আনন্দ স্বরূপ নয়, বরং তিরষ্কার স্বরূপ। (মুসলিম) মহানবী (সা.) আরো ইরশাদ করেন যে, যে ব্যক্তি দুইঈদের রাতে পূণ্যের প্রত্যাশায় ইবাদত- বন্দেগী করে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকদের অন্তর মরে যাবে, কিন্তু কেবল সেই ব্যক্তির অন্তর জীবিত থাকবে, সেদিনও মরবে না। (আতরাগিব)

রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পূণ্যময় পাঁচটি রাতে ইবাদত-বন্দেগী করে সেই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ রয়েছে, আর সেই সুসংবাদটি হচ্ছে ‘জান্নাত’। পূণ্যময় পাঁচটি রাত হলো: ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবে বরাত, জিলহজের রাত ও আরাফাতের রাত।(বায়হাকি)

হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, এক দিন নবী করিম (সা.) হিজরত করে মদিনায় তাশরিফ নিয়ে দেখতে ফেলেন মদিনাবাসীরা, ‘নববর্ষ ও মেহেরজানের’ দুইটি উৎসব পালন করছে, তখন মহানবী (সা.) তাদেরকে জিজ্ঞাস করলেন তোমরা এ দুইদিনে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠ কেন? মদিনার আনসার এবং নওমুসলিমগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল আমরা জাহেলী যুগে এ দুইদিনে আনন্দ উৎসব করতাম, যা আজ পর্যন্তও প্রচলিত।

তখন রাসুল (সা.) তাদেরকে বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সেই দুইটি উৎসবের পরিবর্তে দুইটি উৎসব তোমাদেরকে দান করেছেন। সে দুইটি উৎসব হচ্ছে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। (আবু দাউদ )

ঈদের দিনে অনেক সুন্নাত রয়েছে, ঈদের দিনে শরিয়তের সীমা রেখার ভেতর থেকে যথাসাধ্য সাজ-সজ্জা করা এবং খুশি করা । গোসল করা। সাধ্য অনুযায়ী উত্তম পোশাক পরিধান করা। মিসওয়াক করা। খুব প্রত্যুষে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। ফজরের নামাজ পড়েই খুব সকালে ঈদগাহে যাওয়া। ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খোরমা বা অন্য কোনো মিষ্টি দ্রব্য ভক্ষণ করা, সম্ভব হলে সেমাই, মিষ্টি জাতীয় পিঠা খাওয়া । ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সাদকায়ে ফিতর আদায় করা । ফেতরা আদায়ের লক্ষ্য হলো এই মহান দিনে যাতে দারিদ্র্যপীড়িত কেউ অনাহারের কারণে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়। এ কারণেই ঈদের আগেই ফিতরা আদায়ের নির্দেশ রয়েছে। ঈদের নামাজ ঈদগাহে মাঠে গিয়ে পড়ার সময় ধনী-দরিদ্র এক কাতারে পাশাপাশি দাঁড়াবে । এ ক্ষেত্রে ধনী বলতে পারবে না আমি গরিবের পাশে দাঁড়াবো না। এই বিধান মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয়। ঈদের এই বড় শিক্ষায় মুসলমানরা আলোকিত হোক এ কামনা করি।

স্বাআলো/এস

Share post:

সাবস্ক্রাইব

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

সর্বাধিক পঠিত

আপনার জন্য প্রস্তাবিত
Related

হিট স্ট্রোকে আশংকাজনক হারে মৃত্যু বাড়ছে

সম্পাদকীয়: হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে যশোরের একজন শিক্ষকসহ দেশে...

নিয়ম মেনে আর কবে ভাটা হবে?

সম্পদকীয়: ভাটার ধোঁয়ায় একদিকে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ...

গ্রামের চিকিৎসা সংকট দূর করতে হবে

সম্পদকীয়: অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান মানুষের জীবনের...

সেতু নির্মাণের অনিয়ম বন্ধ করতে হবে

সম্পদকীয়: যশোরে ভৈরব নদের ওপর যে পাঁচটি সেতু নির্মাণ...