spot_img

কবি রাধাপদ রায়ের ওপর হামলা, প্রধান আসামি গ্রেফতার

কুড়িগ্রামে চারণ কবি রাধাপদ রায়ের ওপর হামলা মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বুধবার (৪ অক্টোবর) দুপুরে কুড়িগ্রাম পৌর শহরের শেখ রাসেল অডিটোরিয়াম একটি অনুষ্ঠান থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আল আসাদ মাহফুজুল ইসলাম জানান।

গ্রেফতার রফিকুল ইসলাম নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের কচুয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।

ছেলের কাছে পাওনা ৫০০ টাকাকে কেন্দ্র করে গত শনিবার সকালে দুই ভাই রফিকুল ইসলাম ও কদুর রহমানের সঙ্গে রাধাপদ রায়ের কথা-কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে রাধাপদকে বাঁশের লাঠি দিয়ে মারধর করে জখম করেন তারা।

পরে প্রতিবেশী ও কবির পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান।

এ ঘটনায় দুই ভাইকে আসামি করে রাধাপদের ছেলে যুগলচন্দ্র রায় নাগেশ্বরী থানায় একটি মামলা করেন। ঘটনার পর থেকে আ*সামিরা পলাতক ছিলেন।

কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার আল আসাদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে দিয়ে ডিবি পুলিশের সহায়তায় দুই আসামির মধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অপর আসামিকে গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে বলে জানান পুলিশ সুপার।

এছাড়াও আসামিদের পরিবারের তিন সদস্যকে গত মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডাকা হয় বলে জানান নাগেশ্বরী থানা ওসি আশিকুর রহমান।

তারা হলেন, দুই নম্বর আসামি কদু মিয়ার স্ত্রী, শ্যালক ও শ্বশুর। পরে রাতে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ ও পুলিশ সুপার আল আসাদ মাহফুজুল ইসলাম নাগেশ্বরী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চারণ কবির শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন।

এদিকে, গত সোমবার রাতে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চারণ কবি রাধাপদ রায়ের খোঁজখবর নিতে যান একুশে পদকপ্রাপ্ত মানবাধিকার কর্মী আব্রাহাম লিংকন, কুড়িগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম, জেলা হিন্দু বৈদ্য খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ছানালাল বকসী, সাধারণ সম্পাদক অলক সরকার, সনাক সভাপতি আহসান হাবীব নীলু, জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান বাবু, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রদীপ কুমারসহ কয়েকজন সাংবাদিক।

তারা কবির শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ জানান চেষ্টা করেন।

এ সময় রাধাপদ রায় তাদের বলেন, এটা কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। আমার ও আমার পরিবারের প্রতি বিদ্বেষের কারণে ঘটনাটি ঘটানো হয়ে থাকতে পারে।

ঘটনার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ওই দুইজনের বিরুদ্ধে আমার ছোট ছেলে যুগলচন্দ্র মামলা করেছে। পুলিশ তাদের খুঁজছে বলে জেনেছি।এখন শারীরিক অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো ওষুধ খেয়ে এবং মলম লাগিয়ে শরীরের ব্যথা ক্ষত সারবে কিন্তু মনের ব্যথা সারবে কেমনে।

তিনি আরো জানান, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের মাদাইখাল গোড়ডারা এলাকায় তার জন্ম। বাবার নাম সতীষচন্দ্র সরকার। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাড়িঘর বিক্রি করে স্বপরিবারে ভারতে চলে যান। যুদ্ধ শেষে ভারতে কেনা বাড়ি বিক্রি করে ফের চলে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে।

তার ভাষ্য, মায়ার টান এড়াতে পারিনি। তাই ফিরতে হয়েছে নিজ বাসভূমে।

এলাকায় বংশ পরম্পরায় শান্তি ও সম্প্রতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন দাবি করে তিনি বলেন, কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।

রাধাপদ আরো জানান, এক সময় সংসারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে বড় ছেলে মাধব কুমারকে (৩০) নিয়ে ঢাকায় গিয়ে রড মিস্ত্রির কাজ শুরু করেন তারা। সেখানেই তার কবিতা লেখার হাতেখড়ি।
তখন বেশ কিছু কাব্য রচনা করেন তিনি। সমসাময়িক ঘটনা নিয়েই তার লেখালেখি।

তিনি জানান, ঢাকায় থাকা অবস্থায়ই বিবাদের শুরু। তার বড় ছেলে মাধব কুমারের সঙ্গে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার পৌরসভাস্থ হাসেম বাজার এলাকার শ্রমিক মিলন মিয়ার সাথে ৫০০ টাকা নিয়ে বিবাদ বাঁধে। এই বিবাদের ঘটনা পৌঁছায় নাগেশ্বরী অবধি।

কবি রাধাপদ জানান, এনিয়ে একটি সালিশ বৈঠক হয়। সেখানে ওই টাকা পরিশোধ করেন ছেলে মাধব কুমার।

কিন্তু ঘটনার আরেক সাক্ষী ও মিলনের পরিচিত নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের নন্দনপুর কচুয়ারপাড় গ্রামের দুই ভাই, কদু মিয়া ও রফিকুল ইসলাম এক প্রকার যেচে তার সঙ্গে বিবাদে জড়ান বলে রাধাপদ রায়ের দাবি।

তিনি বলেন, কদু মিয়া আমার বাড়িতে এসে টাকা লেনদেনের সেই ঘটনাটি নিয়ে তর্কে লিপ্ত হন। সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ধরনের তর্ক হয় এটি তেমন ছিলো না। তারা আমাকে ও আমার স্ত্রীকে হেয় করে কথা বলছিল। আমার স্ত্রীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছিলো। আমি সাথে সাথে প্রতিবাদ জানাই।বলি, আমার বাড়িতে এসে তোমরা এমন ভাষা ব্যবহার করে কথা বল কেন? তোমাদের আমি ঘুসি মারবো!

রাধাপদের ভাষ্য, এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কদু মিয়া আমাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। বলেন, ১০ বছর হলেও ছাড়বো না। তোমাদের পাশে কে দাঁড়াবে!’ এরকম অনেক কথায় বলে সে। যদিও ঘটনার কথা আমরা ভুলে যাই।

ভুলে যাওয়া সেই তর্কের প্রায় ৭ মাস পর গত শনিবার ভোরে কদু মিয়া ও তার ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম হঠাৎ তার ওপর হামলা করেন বলে দাবি কবি রাধাপদ রায়ের।

তিনি আরো বলেন, আমি তখন নন্দনপুর ডুবুরির ব্রিজের পাড়ে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলাম। এ সময় রফিকুল ইসলাম বাঁশ দিয়ে আমার পিঠে উপর্যুপরি আঘাত করেন। তারপর তারা আমার চুল-দাড়ি ধরে মাটিতে ফেলে কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। এসময় রফিকুল আমার বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরে বলেন, আমার ভাইকে মারতে চাস, তোকে শেষ করে দিবো। এতে আমি পিঠে ও কোমড়ে আঘাত পাই। পরে আশপাশের লোকজন এসে আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। তখন রফিকুল ও কদু মিয়া আমাকে শাসাতে শাসাতে চলে যান।

রাধাপদ রায়ের ছোট ছেলে যুগলচন্দ্র রায় বলেন, আমি প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় বাবাকে উদ্ধার করে নাগেশ্বরী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। পরদিন ১ অক্টোবর বাদী হয়ে দুই ভাইকে আসামি করে নাগেশ্বরী থানায় মামলা দায়ের করি। তারা বাবাকে অমানুষিকভাবে মারধর করেছে। এতে আমি মানসিকভাবে খুবই কষ্ট পেয়েছি।

রাধাপদ রায়ের মেয়ে সান্ত্বনা রানী বলেন, মাকে তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আমরা এই বর্বর আচরণ ও ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

এ ঘটনায় কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন বলেন, এটি একটি অমানবিক ঘটনা। নাতির বয়সি ব্যক্তির হাতে একজন বয়োবৃদ্ধের নিগ্রহের ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেবে সরকার। এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম আইনজীবী সমিতি সকল প্রকার আইনি সহায়তা দেবে ভিকটিমকে।

তিনি আরো বলেন, তবে উদ্বেগের বিষয়, একটি মহল অপরাধটিকে ধর্মীয় রঙ লাগিয়ে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়ার চেষ্টা করছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং দুএকটি সংবাদমাধ্যম ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, যা বাস্তবতার সাথে মিল নেই। এটা খুবই দুঃখজনক।

সবাইকে সংযমী, ধৈর্যশীল, মানবিক ও দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানান তিনি।

জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলক সরকার বলেন, মামলা হয়েছে, আশা করছি, আসামিরা দ্রুত আইনের আওতায় আসবে। তবে ঘটনাটিকে অনেকেই ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এটি আরো দুঃখজনক।

জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ রাশেদুজ্জামান বাবু বলেন, আমরা পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছি। কবির চিকিৎসা থেকে নিরাপত্তা এবং আইনি সহায়তার বিষয়ে। আমরা আশাবাদী, দ্রুততম সময়ে পুলিশ আসামিদের আদালতে সোপর্দ করতে পারবে।

নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার সাহেব আলী বলেন, কবি রাধাপদকে ফিজিক্যালি এ্যসাল্ট করা হয়। তার পিঠে আঘাতের চিহ্ন আছে। এখনো ব্যথা রয়েছে। তবে তার অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।

পুলিশ সুপার আল আসাদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, পুলিশ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখছে। তদন্ত, নিরাপত্তা, শান্তি, স্থিতিশীল পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে পুলিশ। এছাড়া আরেক আসামিকে ধরতে পুলিশ সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। আমরা অসুস্থ রাধাপদ রায়ের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিচ্ছি। তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।

স্বাআলো/এসএ

Share post:

সাবস্ক্রাইব

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

সর্বাধিক পঠিত

আপনার জন্য
Related

নির্মাণের এক বছর না যেতেই মডেল মসজিদে ফাটল

জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম: জেলার ফুলবাড়ীতে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক...

ফের বাড়ছে পানি, অসহনীয় কষ্ট বানভাসিদের

জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম: জেলার ১৬টি নদ-নদীর পানি গত দুইদিন...

৩৪১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা

জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম: বন্যায় ৩৪১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান সাময়িক বন্ধ...

৩৪১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা

জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে...