কৃষিতে পুরুষ শ্রমিকের সংকট পূরণ করছে নারীরা

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: দেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাট। এক সময় সস্তায় কৃষি শ্রমিক পাওয়া যেতো। এখন দিন পাল্টে গেছে। কৃষিকাজে পুরুষ শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সেই স্থান পূরণ করছে নারীরা। কৃষি কাজে নারীদের সম্পৃক্ত করলে চাষাবাদে বরকত কম হবে। এমন ধারণা হতে বেরিয়ে এসেছে কৃষকরা। এখন নারী শ্রমিকরা নিজেদের অপয়া ভাবে না।

সারাদেশের ন্যায় লালমনিরহাটেও রোপা আমন ধানের মৌসুম চলছে। একযোগে ধান রোপণের কাজ শুরু হওয়ায় ধান চাষাবাদে পুরুষ কৃষি শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে।

পুরুষ শ্রমিকরা তাই একটু বেশি মজুরি পাওয়ার আশায় বগুড়া, ঢাকা, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রামসহ নানা জেলায় কাজে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কারণে উত্তরের জেলাগুলোতে কৃষি কাজে পুরুষ শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কৃষি শ্রমিকের এই সংকট পূরণ হচ্ছে নারী কৃষি শ্রমিক দিয়ে।

এছাড়াও এক সময় মৌলবাদী চক্র অপপ্রচার করে আসছিলো, নারীরা চাষাবাদে শ্রমিকের কাজ করলে ফসল উৎপাদনে বরকত কমে যাবে। ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ নারীদের বাইরে কাজ করা। এখন সেই অবস্থা পাল্টে গেছে। মৌলবাদী চক্রের সেই ফাঁদ হতে নারীরা বেরিয়ে এসেছে। নারীরাও সমান তালে শুধু কৃষিকাজ নয়, প্রায় সকল পেশায় প্রবেশ করেছে।

নারী শ্রমিক মৌসুমী আক্তার (৪০) জানান, স্বামীর একার আয়ে সংসারে স্বচ্ছলতা আনা যাচ্ছে না। তাই স্বামীকে সহায়তা করতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করছি। স্বামী বাড়িতে আসলে মৌসুমী কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ বন্ধ থাকবে। পুরুষ শ্রমিকরা এই সময় কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে যায়। এখানে পাঁচশত টাকা হাজিরা, দক্ষিণাঞ্চলে ঠিকায় কাজ করলে হাজিরা পড়ে এক হাজার থেকে ১২শ টাকা। একটু বেশি পারিশ্রমিকের আশায় এক মাস বাইরে কাজে যায়। এই শ্রম বাজারের পুরুষ শ্রমিক সংকট, গ্রামীণ নারীদের জীবনে আর্শীবাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তারা ঘর-সংসার রক্ষার পাশাপাশি গ্রামে থেকে কাজ করছেন। তবে নারী শ্রমিকদের দাবি তারা

পুরুষের সমান কাজ করো পারিশ্রমিক মিলছে অর্ধেক। এই শ্রম মজুরি বৈষম্য দূর করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। শ্রম কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে নারী কৃষি শ্রমিকরা সমান মজুরি দাবি করেছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে এখন শীতকালীন সবজি, তামাক, রোপা আমন ধান রোপণসহ কৃষি ফসল চাষের ভরা মৌসুম চলছে। বেশি মজুরি পাওয়ার আশায় পুরুষ কৃষিশ্রমিকরা দল বেধে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, ঢাকা, কুমিল্লা, বগুড়া, রাজশাহীসহ অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে উত্তরের লালমনিরহাট জেলায় কৃষিশ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চড়াদামেও পুরুষ কৃষি শ্রমিক মিলছে না। এই সুযোগে কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। প্রতিটি ফসলের মাঠে এখন নারী শ্রমিকের দলবেধে কাজ করার সরব দৃশ্য দেখা যায়। গ্রামের পথে হাঁটলে চোখে পড়বে এ দৃশ্য। গ্রাম্য গৃহবধূরা এখন দক্ষ কৃষি শ্রমিক হয়ে উঠেছে। তারা ফসলের মাঠে লোকলজ্জা উপেক্ষা করে স্বাচ্ছন্দ্য কাজ করছে।

উত্তরের জেলাগুলোতে কৃষি কাজে শ্রমিক সংকটের বিকল্প হিসেবে নারী কৃষি শ্রমিককের চাহিদা তৈরি হয়েছে। সাশ্রয়ী মূল্যে নারী শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে। তাতে কৃষকের শস্য উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয়ী হচ্ছে। কৃষিখাতে নারীর কর্মসংস্থানের প্রভাব দৈনন্দিন জীবনযাপনে পড়েছে। জীবনমান কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। কৃষিখাতে এসব নারী শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিলে আরো কর্মসেবা পাওয়া সম্ভব হবে।

বাংলার অবলা নারীর এখন আর অবলা নয়। গামেন্টর্স সেক্টরের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা কৃষিতেও শক্ত ভীত তৈরি করে ফেলেছে। প্রতিটি নারীর হাত দক্ষ কৃষি শ্রমিকের হাতে পরিণত হয়েছে। কৃষিখাতে নারী শ্রমিক মজুরি বৈষম্য পড়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে। পুরুষ পারিশ্রমিকের সমান কাজ করে মজুরি পুরুষের অর্ধেক পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। নারী-পুরুষের এই কৃষি শ্রমের মজুরি বৈষম্য দূর করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। কৃষি শ্রমিকের মজুরি আইন বলবৎ করার দাবি জানিয়েছেন।

অর্থনীতির সূত্রে চাহিদা ও যোগান পণ্যের মূল্য নিধারণে তারতম্য সৃষ্টি করে থাকে। শ্রম মজুরির বেলাও তাই। কৃষি শ্রমিকের কাজের অভাব নেই কিন্তু নারী শ্রমিক সঠিক শ্রমের মূল্য পাচ্ছে না। এই বৈষম্য শ্রম মজুরিতে নারী পুরুষের অর্থনৈতিক বৈষম্যে ফেলেছে। দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দেখা দিতে পারে কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ।

দেশের কৃষিজ অর্থনীতিতে নারী শ্রমিকের শ্রম শক্তি যোগ হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি উচ্চমাত্রায় পৌঁছে গেছে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি উন্নয়নের সব সূচককে ঊর্ধ্বমুখী করেছে। কৃষি নির্ভর গ্রাম-বাংলায় সারা বছর কৃষিকাজের দিনমজুরিতে নারীর ব্যাপক হারে স্থায়ী কর্মসংস্থান ঘটেছে। এতে করে অশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত ও স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পূর্ণ কর্মক্ষম নারীর বাড়ির পাশেই কৃষিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। একই সংসারের নারী-পুরুষ দুই জনে কৃষি শ্রম বিক্রি করে আয় দ্বিগুণ করেছে। এতে সাংসারিক দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে কিছুটা সঞ্চয় হচ্ছে। এভাবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। যা দশ বছর আগে ছিল দিবাস্বপ্ন। কৃষিখাতে মৌসুমী কাজের অভাবে সেই সময় উত্তরের প্রতিটি গ্রামে দেখাা দিয়ে ছিলো মঙ্গা। যা ছিলো রংপর-লালমনিরহাট অঞ্চলের মানুষের জীবনে অভিশাপ। সেই চিত্র এখন নেই। কৃষিতে ফসল ফলানোতে কৃষক এনেছে নানা বৈচিত্র। যা কৃষি, কৃষক ও কৃষিশ্রমিকের সমৃদ্ধি অর্জনে অনুঘটকের কাজ করেছে। বর্তমান সরকার কৃষিখাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ায় কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

পটুয়াখালীতে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে মিছিল

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখা কবিতায় লিখেছেন, বিশ্বে যা কিছু চির কল্যাণকর অর্ধেক তার গড়েছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশে ধর্মীয় গোড়ামি, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তার অভাবসহ নানা কারণে তৃণমূল পর্যায়ে নারীর কর্মসংস্থানে অনীহা ছিলো। দেশের মোট জনশক্তির অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তেমন সম্পৃক্ত করতে আগ্রহ দেখাননি। বর্তমান সরকার সরকারি সব বাহিনীতে তৃণমূলের কর্মী নিয়োগ দিয়েছে নারীকে। এই কার্যক্রমের পর হতে সকল কাজে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এর সুফল কৃষিকাজে আজকের নারী শ্রমিকের আধিক্যতা। স্বল্প আয়ের সংসারে দুই জন বা অধিক নারী সদস্য কৃষি কাজ করে পরিবারে বাড়তি আয় করে সমৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। নিম্ন আয়ের মানুষের সংসারে স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামীণ অশিক্ষিত, সুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নারীর উপার্জন করায় পারিবারিক মর্যাদা ও পারিবারিক নীতিনির্ধারণীতে নারীর মতামতের গুরুত্ব বেড়েছে। সেই সাথে পরিবারে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। নারীর পর নির্ভরতা হ্রাস পেয়েছে। পরিবারে উপার্জন করায় নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারছে। নারীর সামাজিক, পারিবারিক মূল্যায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।

দুই দশক আগেও কোনো মুসলিম নারীকে গ্রামের কৃষি ফসলের মাঠে কাঁদা পানিতে ধানের চারা রোপণ, আগাছা নিড়ানি, ধানকাটা মাড়াইসহ শক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ কৃষিখাতের কায়িক শ্রমের কাজ করতে দেখা যেত না। মুসলিম নারীরা খেত-খামারে কাজ করবে সেটা কল্পনার বাইরে ছিলো। সেই সময় উত্তরের কয়েকটি জেলার কিছু আদিবাসী, নিম্নবর্ণের অমুসলিম পরিবারের নারী শ্রমিকদের ক্ষেতে-খামারে স্বল্প পারিশ্রমিকে কৃষি কাজ করতে দেখা গেছে।

এখন দিন পাল্টে গেছে। সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে, সন্তানদের শিক্ষাগ্রহণ সহায়তা করতে ও কিছুটা উন্নত জীবনযাপন করতে অমুসলিম পরিবারের নারী শ্রমিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুসলিম নারীরাও কৃষি জমিতে কাজ করছে। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদিতা, নারী বিদ্বেষ, ফতোয়াবাজি, নারীর প্রতি হীনমন্যতা বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। বর্তমানে ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার দীর্ঘমেয়াদী একটানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় নারীবান্ধব মনোভাব মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে।

নারী শ্রমিক হাজেরা খাতুন (৪৫) জানান, লালমনিরহাটের স্থানভেদে একজন নারী কৃষি শ্রমিক দৈনিক মজুরি হয়ে থাকে ২৫০/ ৩০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিকের মজুরি একই কাজে হয়ে থাকে সাড় ৪০০ টাকা হতে ৫০০ টাকা। এতেই বুঝবেন কতটা মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিক। যদিও দেশের প্রচলিত আইনে কোন শ্রমের মজুরি নির্ধারণে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রাখেনি। বরং মজুরি আইনে নারী ও শিশু শ্রমিকের কায়িক শ্রমে ঝুঁকি মুক্ত রাখতে শ্রম আইনে অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। শ্রম আইনে নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্ম সংস্থানে যুগোপযোগী আইন রয়েছে। আমাদের দেশে কল কারখানায় শ্রম আইন ও মজুরি আইন বলবদ রয়েছে। এই দুইটি আইন দিয়ে রাষ্ট্র তার দেশের প্রধান চালিকাশক্তি শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে। তাই কৃষি কাজে নারী ব্যাপকহারে সম্পৃক্ততা বেড়েছে।

দেশীয় খেলাগুলো যেনো হারিয়ে না যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৃষিবিদ রুহুল আমীন লিটন জানান, পৃথিবীর বুকে কৃষি নারীর হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে। নারী শ্রমিক কৃষিকাজে শ্রম ঘণ্টার অপচয় কম করে থাকে। একজন পুরুষ কৃষিশ্রমিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে ধূমপানসহ নানা বাহানায় সময় অপচয় করতে পারে। নারী শ্রমিকের বেলায় এটা কম হয়।

স্বাআলো/এস

Share post:

সাবস্ক্রাইব

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

সর্বাধিক পঠিত

আপনার জন্য প্রস্তাবিত
Related

কালীগঞ্জে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হলেন লুবনা

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ...

পানি সংকট ও তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে ক্ষেত

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে...

একটি গরু থেকে খামার, দুধ বিক্রি করে বছরে আয় ১৫ লাখ টাকা

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: জেলার পাটগ্রামে একটি গাভী থেকে পর্যায়ক্রমে...

গাছ থেকে আ.লীগ নেতার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় তিস্তা নদীর তীরে...